ইংরেজ-ভূটিয়া চুক্তির মর্মার্থ অনুসারে সমস্ত বেদখল রাজ্যাংশ উদ্ধার না করেই ভূটান-যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে ইংরেজের ভুটিয়া-তোষণ নীতির যে সূত্রপাত 1772 খ্রিস্টাব্দে শুরু করেছিল, সে নীতি প্রায় এক শতাব্দী পর্যন্ত বজায় ছিল। এই অসম্পূর্ণ বিজয়েও কিন্তু কোচবিহাররাজ কোনো আপত্তি তোলেননি। নাবালক রাজার কাছে আর কোনো উচ্চাশাও বোধ হয় ছিল না। একরতফা যুদ্ধবিরতির শর্তে অবশ্য ভুটানরাজ্যে কারারুদ্ধ মহারাজ ধৈর্যেন্দ্রনারায়ণ, তাঁর ভ্রাতা সুরেন্দ্রনারায়ণ, দেওয়ানদেব ও অন্যান্য বন্দিগণ মুক্তি পেলেন। মুক্তিপ্রাপ্ত মহারাজ ধৈর্যেন্দ্রনারায়ণ যখন জানতে পারলেন যে, তাঁর মুক্তির বিনিময়ে স্বাধীন কোচবিহার রাজ্যকে করদরাজ্যে পরিণত করা হয়েছে তখন তিনি সিংহাসনে আরোহণ করতে অস্বীকার করেন এবং শোকাহত এই স্বাধীনচেতা রাজা সম্পূর্ণভাবে বারুদ্ধ হলেন ও ভগবতী-চরণে নিজেকে উৎসর্গ করে সাধন-ভজনে আত্মনিয়োগ করেন। সুতরাং, নাবালক ধরেন্দ্রনারায়ণই সিংহাসনে আসীন হন।
1774 খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি ভুটান সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদিত করে। এই চুক্তির মধ্যে আক্রমণকারী এবং পরাজিত ভুটান সরকারের প্রতি দমনমূলক বা কঠোর কোনো শর্ত তো ছিল না, বরং ছিল বিজেতার তরফ থেকে বিজিতকে খুশি করার প্রচেষ্টা। এই সন্ধির শর্ত অনুযায়ী, পশ্চিমে তিস্তা থেকে পূর্বে সংকোশ নদী পর্যন্ত হিমালয় পাদদেশীয় বিপুল ভূখণ্ড, যা কোচরাজ্যভুক্ত ছিল এবং যুদ্ধশেষে তাদেরই পাওয়ার কথা, তা সবই ভুটান সরকারকে দেওয়া হয়। একদিকে ইংরেজের যেমন পরাজিতকে তোয়াজ করার চেষ্টা, অন্যদিকে তেমনি শুরু হয় সন্ধিবদ্ধ কোচবিহারকে শোষণের চেষ্টা। দফায় দফায় কোচবিহারের বার্ষিক একরের বোঝা বাড়িয়ে যাওয়াতেই তার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন- 1772 খ্রিস্টাব্দে শ্বিরীকৃত কর 50 হাজার টাকার পরিবর্তে 1774 খ্রিস্টাব্দে এক লক্ষ টাকা ধার্য হয়। অতিরিক্ত কর-ভারে কোচবিহারের রাজা ও প্রজা উভয়ের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে ওঠে। কুটিয়া-তোষণনীতির পরোক্ষ ফল হিসেবে নেমে আসে প্রান্তিক উত্তর বাংলায় মধ্যযুগীয় অরাজকতা। অভূটিয়া সমতলবাসী প্রজাদের প্রতি ভুটানিদের কোনো আত্মিক সম্পর্ক বা মানসিক দুর্বলতা না-থাকায় সন্ধির ফলে প্রাপ্ত সমতলের রাজ্যাংশে তারা জোরজুলুম করে রাজস্ব আদায়, এমনকি সংঘবদ্ধ সৈন্যবাহিনী দিয়ে লুণ্ঠন ও হত্যা চালাতে থাকে। তা ছাড়া কোচবিহারের রাজ্যাংশে ঢুকে পড়েও হামলা চালাতে থাকে। দুর্বল কোচরাজের পক্ষে প্রজার দুর্ভাগ্য দূরীকরণের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। ইংরেজ সরকারকে সে কথা জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি, কারণ সে কোম্পানি তখন ভুটান সরকারকে তুষ্ট রেখে, ভুটানের সঙ্গে তো বটেই, ভুটানের মধ্য দিয়ে তিব্বতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়িয়ে আর্থিক প্রতিপত্তির স্বপ্নে বিভোর। একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, ইংরেজের ভুটান-তোষণনীতি উত্তর প্রান্তিক বাংলার সমূহ অকল্যাণসাধন করেছিল।