খেন রাজাদের অধীনে কামতা রাজ্যের উদ্ভব আলোচনা করো। (Discuss the emergence of the Kamta Kingdom under the Khen kings.)

ভারতবর্ষের পূর্ব অংশে সুবিস্তৃত গিরিরাজ হিমালয়ের পাদদেশে যে দেশ প্রাচীনকালে প্রাগজ্যোতিষপুর নামে পরিচিত ছিল কালের ব্যবধানে সেই বিস্তীর্ণ ভৌগোলিক ক্ষেত্রই লৌহিত্য, কামরূপ এবং কামতা রাজ্য নামে পরিচিত হয়। রামায়ণ, মহাভারত, হরিবংশ, বায়ুপুরাণ ও মৎস্যপুরাণ ইত্যাদিতে প্রাগজ্যোতিষপুর নাম পাওয়া যায়। কামরূপ পরবর্তীকালের নাম। প্রয়াগের অশোক স্তম্ভে সমুদ্রগুপ্তের দিগ্বিজয় প্রসঙ্গে কামরূপ রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায় (4) Century AD)। পঞ্চদশ শতকে হোসেন শাহী মুদ্রায় ‘কামতা’ ও ‘কামরূপ’ নামক এই দুটি দেশের নাম পাওয়া যায়।

প্রাচীনকালে কামরূপ দেশের আয়তন কতদূর বিস্তৃত ছিল কালিকাপুরাণ এবং যোগিনীতন্ত্রে বর্ণিত হয়েছে। কালিকাপুরাণে লিখিত আছে যে, পূর্বদিকে ললিতকান্ডার এবং পশ্চিমে করতোয়া নদীর মধ্যবর্তী এই প্রদেশ দৈর্ঘ্যে ত্রিশ যোজন এবং প্রস্থে একশত যোজন বিস্তৃত। কামরূপ বা কামতা রাজ্যের রাজনৈতিক উত্থানে খেন বংশের অবদান ‘অনস্বীকার্য। খেন বংশীয় তিনজন রাজার নাম ইতিহাস প্রসিদ্ধ। এনারা হলেন নীলধ্বজ, চক্রধ্বজ এবং নীলাম্বর। রাধাকুর দাস বৈরাগী বিরচিত ‘গোসানীমঙ্গল’ পুথিতে কামতাপুর। সম্বন্ধীয বিভিন্ন জনশ্রুতি লিপিবদ্ধ আছে। উক্ত পুথিতে লিখিত আছে যে কামতাপুর রাজ্যে প্রথমে রাজত্ব করতেন রাজা শ্রীবৎস। তারপর ভগদত্ত-এর রাজ্য আরম্ভ হয়। মহাভারতে ভগদত্তের উল্লেখ আছে। একটি মতবাদ অনুসারে খেন বংশের প্রথম রাজা নীলধ্বজ খ্যাতনামা রাজা হবুচন্দ্রের উত্তরাধিকারী পাল বংশীয় অন্তিম রাজাকে গৌহাটির নিকট পরাজিত করে কামতাপুরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেছিলেন। রাজা নীলধ্বজের শাসনকাল। নিয়ে নানা মতবাদ প্রচলিত আছে। বিশ্বকোশে কামতাপুরের নীলধ্বভকে চণ্ডীবরের পরী রাজধরের সমসাময়িক বলা হয়েছে। (1328-1338 CE)। গৌড়ের ইতিহাসে নীলধ্বজের রাজ্যারস্ত কাল 1328 খ্রিস্টাব্দ বর্ণিত হয়েছে। শঙ্করদেবের শিষ্য শ্রুতিধর রূপনারায়ণ ‘কামতেশ্বর কুলকারিকা’য় কামতেশ্বর গণকে রাজ্যবর্ধনে বংশধর বলে উল্লেখ করেছেন। রাজা নীলধ্বজের পূর্বনাম ছিল কাণ্ডেশ্বর। কামতাপুরের নিকটস্থ জামবাড়ি গ্রামে খেন উপজাতীয় বংশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল ভক্তেশ্বর এবং মাতার নাম অঙ্গনা। বাল্যকালেই তাঁর পিতার মৃত্যুর কারণে অত্যন্ত দরিদ্রতার দরুন তাঁর মাতা কাণ্ডেশ্বরকে এক ব্রাহ্মণের গোপালক রূপে নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু নিজ কর্তব্যে বালক কাণ্ডেশ্বর মনোযোগী ছিলেন না। একদিন কাণ্ডেশ্বরের প্রভু জনৈক ব্রাহ্মণ দেখতে পান যে একটি বিষধর সর্প নিদ্রিত কাণ্ডেশ্বরকে ছায়াপ্রদান করছে এবং এই বালকের হাতে ও পায়ে রাজচিহ্ন বর্তমান। এই সকল রাজলক্ষণ প্রত্যক্ষ করে ব্রাহ্মণ কাণ্ডেশ্বর-এর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেন যে ভবিষ্যতে কাণ্ডেশ্বর রাজা হলে, তাঁকে তার রাজগুরু নির্বাচিত করবেন। সময়ান্তরে কাণ্ডেশ্বর কামতাপুরের রাজা হন এবং পূর্ব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন। তিনি সিংহাসনে বসে ‘নীলধ্বজ’ উপাধি গ্রহণ করেন।

ধরলা নদীর পশ্চিম প্রান্তে নীলধ্বজ তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন এবং একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ নির্মাণ করেন। ধরলা নদীর তীরে তিনি খেন বংশের উপাস্যদেবী কামতেশ্বরীর একটি মন্দিরও নির্মাণ করেন। নীলধ্বজের পর তাঁর পুত্র চক্রধ্বজ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রাজ্যের রাজত্বকালে কামতাপুরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী গোসানী দেবীর মন্দির আবিষ্কৃত হয়। কথিত আছে, জ্যোতিষের রাজা ভগদত্ত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে নিহত হলে তার কবচ যুদ্ধক্ষেত্রে অযত্নে পতিত হয় হয় এবং পরবর্তীকালে রাজা চক্রধ্বজ স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে সেই কবচ রাজধানী কামতাপুরে স্থাপন করেন। খেন বংশের তৃতীয় এবং শেষ রাজা ছিলেন নীলাম্বর। গোয়ালপাড়া, কামরূপ, সমগ্র রংপুর, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি এবং দিনাজপুরের অংশবিশেষ রাজা নীলাম্বরের অধীনস্থ ছিল। তাঁর রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্ত ঘোড়াঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং ঘোড়াঘাটে তিনি দুর্গও নির্মাণ করেছিলেন। তিনি রাজধানী কামতাপুর থেকে রাজ্যের প্রাপ্ত সীমান্তে অনেকখানি রাজপথ নির্মাণ করেছিলেন। তাদের মধ্যে বর্তমানে জলপাইগুড়ির অন্তর্গত জল্পেশ্বর মন্দির পর্যন্ত উত্তর-পশ্চিম অভিমুখে একটি পথ নির্মিত হয়েছিল। সেই পথপার্শ্বে প্রতি দু-এক মাইল অন্তর এক-একটি জলাশয়ের খনন চিহ্ন আজও বর্তমান।

দিকথিত আছে, কামতেশ্বরগণ পশ্চিমে করতোয়া থেকে পূর্বে কামরূপের বড়ো নদী জিয়া উত্তরে ভূটান পর্বত থেকে দক্ষিণে বগুড়া জেলা পর্যন্ত বিস্তৃর্ণ ভূভাগে রাজ্যবিস্তার হেরেছিলেন। গৌড়শ্বর আহমদ শাহের রাজত্বকালে (1431-42 CE) পাঠান রাজ্যশক্তি সান্ত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ায় কামতেশ্বরগণের পক্ষে রাজ্যবিস্তারের বিশেষ সুবিধা হয়েছিল। সমসাময়িক ইউরোপীয় ভ্রমণকারীদের বৃত্তান্তেও কামতা রাজ্যের উল্লেখ আছে।

নীলাম্বরের রাজত্বকালে কামতারাজ্য তার সমৃদ্ধির শিখরে অবস্থান করেছিল। কিন্তু নীলাম্বর-এর সময় থেকেই ক্রমাগত মুসলিম আক্রমণে খেন বংশের পতন ঘটে। নীলাম্বরের মন্ত্রী কাশীপাত্রের আহবানে বাংলার তৎকালীন মুসলিম শাসক শাহ (1483 CE) কামতাপুর আক্রমণ করে। দীর্ঘ দ্বাদশবর্ষব্যাপী অবরোধের পরও তারা কামতা রাজ্য সম্পূর্ণরূপে অধিকার করতে ব্যর্থ হয়, তখন চক্রান্ত করে বহুসংখ্যক সৈন্য নারীর ছদ্মবেশে দুর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে শেষ পর্যন্ত বন্দি করতে সমর্থ হয়। রাজা নীলাম্বর শত্রুহস্তে বন্দি হয়ে ‘কাজলী কুড়া’ নামক জলাশয়ে স্নানকালে অন্তর্হিত হন। নীলাম্বরের পরাজয়ের সঙ্গো সঙ্গ্যেই খেন বংশের পতন ঘটে এবং হোসেন শাহ কামতা রাজ্যে পুত্র দানিয়েলকে গভর্নর নিযুক্ত করে আরও পূর্বদিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। এভাবে কামতা রাজ্যে খেন বংশের গৌরবময় সূর্য অস্তমিত হয়।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading