রবীন্দ্রোত্তরকালে সবচেয়ে স্বতন্ত্রচিহ্নিত কবি জীবনানন্দ দাশ। তিনি নির্জনতার কবি, প্রকৃতির কবি, সময়ের কবি। তাঁর মনে হয়েছিল-“সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।” তিনি ‘বিপন্ন বিস্ময়’-এর কবি। জীবনানন্দের কবিতার আবেদন আমাদের মস্তিষ্কের কাছে। ইতিহাসচেতনার সঙ্গে সময়চেতনা ও কালচেতনা মিলেমিশে রয়েছে তাঁর কবিতায়। মস্তিষ্কবোধের সন্ধানে তিনি এগিয়ে যান। তিনি এক ‘বোধ’-এর কবি।
জীবনানন্দ দাশের কাব্যগুলি হল-‘ঝরা পালক’ (১৯২৭), ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ (১৯৩৬), ‘বনলতা সেন’ (১৯৪২), ‘মহাপৃথিবী’ (১৯৪৪), ‘সাতটি তারার তিমির’ (১৯৪৮) ও ‘রূপসী বাংলা’ (১৯৫৭)। জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘বনলতা সেন’।
এমনকি নাম-কবিতা ‘বনলতা সেন’ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রেমের কবিতা। প্রেম, ইতিহাস, কল্পনা এখানে পাশাপাশি অবস্থান করে আছে। নায়িকার সন্ধানে প্রেমিক হাজার বছর ধরে হেঁটে চলেছেন-
“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে।”
‘কবিতার কথা’ গ্রন্থে জীবনানন্দ জানিয়েছেন-“কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।” ইতিহাসচেতনার পাশাপাশি সময়-চেতনা তাঁর কবিতায় বড়ো আকার ধারণ করেছে। তিনি প্রেমের কবি, জীবনের কবি। জীবনানন্দের নায়িকারা বারবার কল্পনার জগতে ঘুরে বেড়ায়। তিনিই লিখতে পেরেছিলেন-“এই পৃথিবীর রণরন্ত সফলতা সত্য/তবু শেষ সত্য নয়।” আসলে শেষ সত্য প্রেম। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা। ‘সুচেতনা’ কবিতায় শুনতে পাই-
“সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে-এ-পথেই পৃথিবীর
ক্রমমুক্তি হবে;
সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ;
এ-বাতাস কি পরম সূর্যকরোজ্জ্বল
প্রায় তত দূর ভালো মানব সমাজ”
জীবনানন্দ দাশের অন্যতম দুটি কবিতা হল-‘বোধ’ ও ‘আট বছর আগের একদিন’। সর্বদা আমাদের ভিতরে এক, বোধ কাজ করে। যে বোধের সন্ধান ব্যক্তিমানুষ নিজেও জানে না, জানা সম্ভব নয়। তেমনি সংসারে সব থাকা সত্ত্বেও তাঁর নায়ক মর্গের দিকে এগিয়ে যায়। মনের ভেতর ঘটতে চলা সমস্ত অনুঘটনার সন্ধান মানুষ নিজেও জানে না। ‘বোধ’ কবিতায় শুনতে পাই-
“আলো-অন্ধকারে যাই-মাথার ভিতরে
স্বল্প নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে।
স্বপ্ন নয়-শান্তি নয়-ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়।”
জীবনানন্দ প্রকৃতির কবি। ‘রূপসী বাংলা’ নামক সনেট গ্রন্থে বাংলাদেশের প্রকৃতির অনবদ্য বর্ণনা এনেছেন। বাংলাদেশের ফুল, পাখি, গাছ, লতা নিয়ে তাঁর কাব্যসজ্জা ফুটে ওঠে। বাংলার নদীনালা, মাঠঘাট দেখে তিনি মুগ্ধ, ফলে পৃথিবীর রূপ খুঁজতে তিনি যান না। বাংলার প্রকৃতিকেই দু-চোখ ভরে মুগ্ধভাবে দেখেন। ‘রূপসী বাংলা’ সনেটে শুনতে পাই-
“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর; অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে বসে আছে ভোরের দোয়েল পাখি-“
রবীন্দ্রত্তোর যুগের বাংলা কবিতার একজন শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ। বক্তব্য অপেক্ষা
গহন মনের রহস্য উন্মোচনে তিনি অগ্রসর হয়েছেন। জটিল জীবন জিজ্ঞাসার কবি জীবনানন্দ দাশ। উদ্ভ্রান্ত যুগের সমস্ত রহস্য খুঁজেছেন তিনি। অনেক সময় তিনি নিজেই। জানেন না জীবনের মানে। মাত্র ছ-টি কাব্যেই তিনি বাংলা কবিতার জগতে চির আসন করে নিয়েছেন।