ভূমিকা:
মূলত রাজস্থান, বুন্দেলখণ্ড অঞ্চল এবং হিমালয় সংলগ্ন পার্বত্য অঞ্চলে রাজপুত চিত্রকলার ব্যপ্তি সীমাবদ্ধ ছিল। ভৌগোলিক এবং আঙ্গিক ও কৌশলগত (শৈলী) রীতির উপর ভিত্তি করে রাজপুত চিত্রকলার মধ্যে আবার দুটি উপবিভাগ লক্ষ্য করা যায়—১। রাজস্থানী চিত্রকলা- 1-এর ব্যপ্তি ছিল ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ। ২। পাহাড়ী চিত্রকলা—সপ্তদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালে বাশোলি, কাংড়া, চাম্বা, মাণ্ডি, হরিপুর, তেহরি-গাড়োয়াল, গুলের নুরপুর, রামপুর ইত্যাদি অঞ্চলে পাহাড়ী শিল্পরীতির প্রভাব দেখা যায়।
রাজস্থানী চিত্রকলা :
সমগ্র রাজপুতানাসহ বুন্দেলখণ্ডের বিভিন্ন এলাকায়—মেবার (উদয়পুর), জয়পুর, বুন্দি, বিকানির, উজ্জয়িনী, যোধপুর (মাড়োয়ার), মালব প্রভৃতি অঞ্চলে রাজস্থানী চিত্রকলা বিকাশ লাভ করে। ষোড়শ শতাব্দীতে রাজস্থানী শিল্পশৈলী বিকাশের পিছনে প্রধান দুটি উপাদান কাজ করেছিল রাজস্থান অঞ্চলে এক সমৃদ্ধ বণিকগোষ্ঠীর উদ্ভব এবং ভক্তিধর্ম প্রভাবিত বৈষ্ণববাদের পুনরুত্থান।
চতুর্দশ শতকে রামানুজের মত বিষ্ণুর উপাসক কবি এবং জয়দেবের মত কৃষ্ণ-উপাসক কবি ও লেখকদের প্রভাবে শুধুমাত্র ভারতীয় ভাবজগতে নয়, সাহিত্য ও শিল্পকলাতেও পুনর্জাগরণ লক্ষ্য করা যায়। চৈতন্য এবং মীরাবাঈ কৃষ্ণের প্রতি চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে ভারতব্যাপী প্রেমরসের জোয়ার ওঠে। পাহাড়ি চিত্রকলার মত রাজস্থানী চিত্রকলাতেও রামানন্দ, তুলসী দাস ও কবীরের গভীর প্রভাব পড়েছিল। এঁদের বানী ও বানী প্রকাশের মাধ্যমগুলির মধ্যে দিয়ে শিল্পীদের কল্পনার জগতে একটি নতুন ক্ষেত্র রচিত হয়। ‘শ্রীরামচরিত’, ‘গীতগোবিন্দ’, রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনী এবং ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের উপর আধারিত রাগ-রাগিনী চিত্রকলার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।
রাজপুত সংস্কৃতি মূলত সামরিক ও সামন্ততান্ত্রিক এবং একই সঙ্গে ধর্মীয় ও জনপ্রিয়। মুঘল যুগে রাজপুতদের সঙ্গে সম্রাটদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় রাজপুতরা মুঘল শিল্পরীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। জাহাঙ্গীরের আমলে একটি ছবিতে মেবারের রানা করণ সিংহকে সম্রাটের সঙ্গে একত্রে দেখা যায়। করণ সিংহ ছিলেন রাণা প্রতাপের পৌত্র। মুঘল আমলে রাজপুতানার দরবারী শিল্পীদের মুঘল রীতিতে ছবি আঁকার নির্দেশ দেওয়া হতে থাকে। ফলে মুঘল শাসনের আগে রাজপুতরা ঈশ্বরের মহিমা কীর্তন করে যে ধরনের ছবি আঁকতেন তার পরিবর্তে মুঘল মিনিয়েচার, প্রতিকৃতি অঙ্কন ও ঐতিহাসিক ঘটনাকে তাঁরা তুলির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে আগ্রহী হন, রাজস্থানী চিত্রকলা
রাজস্থানের স্থানীয় রাজ্যগুলির শাসকেরা নিজেদের হিন্দু ধর্ম, বিশ্বাস, সংস্কৃতির রক্ষক ও অভিভাবক বলে মনে করতেন। তাঁরা সাহসিকতাপূর্ণ ও কষ্টকর জীবনশৈলীকে আদর্শ বলে গ্রহণ করেন। রাজপুত রমণীরা তাঁদের সতীত্ব রক্ষা করার জন্য জহরব্রত পালন করতেন। রাজপুত জীবনের কঠোরতর এই পরিবেশে রামচন্দ্র বা প্রভু কৃষ্ণের প্রতি আত্মসমর্পণ তাঁদের জীবন যন্ত্রণা উপশমের একটি অবলম্বন হয়ে উঠেছিল। রোমান্স ও ফ্যান্টাসির প্রতি আকর্ষণ ফুটে উঠেছিল তাদের চিত্রকলার বিষয়বস্তুতে। ইতিপূর্বে যে মূল্যবান চিত্রগুলি শুধুমাত্র রাজা ও সভাসদের অধিকারে ছিল তা ক্রমে জনগণের কাছাকাছি পৌঁছায়। চিরায়ত রামায়ণ ও মহাভারতের ধর্মীয় বিষয়গুলিকে চিত্র-সজ্জিত করে রোমান্টিকতা ও ফ্যান্টাসির মোড়কে শিল্পীরা তুলে ধরতে থাকেন। ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যের লীলাময় কৃষ্ণ, ভাগবতপুরাণ, সুরদাস, বেশবদাস,
বিহারীলালের রচনাসমূহ রাজস্থানী চিত্রকলার বিষয়বস্তুতে স্থান পায়। জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্যে রাধাকৃষ্ণের প্রেমের যে লৌকিক ও রূপকধর্মী রূপের প্রকাশ ঘটে তার মাধ্যমে রাজপুত শিল্পীরা মানুষের হৃদয়াত্মার সঙ্গে দেবতার মিলনের সাধনায় রত হন।
রাজস্থানী রীতি প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন আঞ্চলিক রীতি ও বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়। প্রথমে এর মূল ছিল একান্তভাবে দেশীয়। কিন্তু ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে মুঘল চিত্রশৈলীর সংস্পর্শে এসে এর রূপান্তর ঘটতে শুরু করে। মুঘলরা রাজস্থানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দক্ষ চিত্রকরদের আহ্বান করে তাদের চিত্রশালায় নিযুক্ত করেন। ফলে উভয় ঘরানার শিল্পরীতিই সমৃদ্ধ হয়। ঔরঙ্গজেবের আমলে চিত্রকরগণ রাজ-অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হলে অনেকেই মুঘল দরবার ত্যাগ করে রাজপুতানার বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নেন। এইভাবে রাজস্থানী শিল্পশৈলী মুঘল শৈলী দ্বারা প্রভাবিত হয়।
ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য অভিযানের সময় বহু রাজপুত বীর ও তাঁদের পারিষদবর্গ, যাঁদের মধ্যে অনেকে চিত্রকর ছিলেন, দক্ষিণীরীতির সঙ্গে পরিচিত হন। বিকানিরের রাজা বিজাপুর, গোলকুণ্ডা ও আহম্মদনগরের থেকে বহু ছবি সঙ্গে নিয়ে আসেন। অন্যদিকে অনেক রাজপুত সেনাপতি দক্ষিণ ভারত থেকে শিল্পীদের এনে নিজেদের কাজে নিযুক্ত করেন। এইভাবে রাজস্থানী চিত্রে দাক্ষিণাত্যের প্রভাব পড়ে। ঔরঙ্গজেবের পরবর্তীকালে দিল্লী থেকে দরবারী শিল্পীরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। এঁদের একটি বড় অংশ রাজপুতানায় এসে আশ্রয় নেন।
রাজস্থানী চিত্রকলা বিষয়বস্তু :
রাজস্থানী চিত্রের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছিল ভারতীয় জীবন ও চিন্তাধারা। এর বিষয়বৈচিত্র্য সহজেই লক্ষ্য করা যায়। রাজস্থানী চিত্রকলার বিষয়সত্ত্বায় প্রকাশ পেয়েছিল প্রেমের এক ধ্যানস্থ রূপ।
ভালোবাসার সমস্ত আঙ্গিকগুলিকে যেন শিল্পীরা কাব্যের ছন্দে ছবিতে ঢেলে সাজিয়েছিলেন। উদাহরণ—‘নায়ক-নায়িকা ভেদ’ (শাস্ত্রে বর্ণিত নায়ক ও নায়িকার শ্রেণি চরিত্র বর্ণনা), ঢোলা-মারু প্রেমকাহিনী (রাজস্থান), সোহনী-মোহনলাল প্রেমকাহিনী (পাঞ্জাব ও সিন্ধ), সুফি দাউদ মউলানা রচিত ‘লোর ও চন্দ্রার প্রেমকাহিনী’, যা একাধারে লোকগাথা ও বীরগাথা—সেগুলি তাঁদের চিত্রকলায় উঠে আসতে থাকে (বানভট্টের ‘কাদম্বরী’, ‘রসিকপ্রিয়’‘রামচন্দ্রিকা’, ‘চৌরাপঞ্চশিকা’, নল-দময়ন্তীর প্রেমাখ্যানও রাজস্থানী চিত্রকলার বিষয় হিসেবে স্থান পায়।
রাজস্থানী চিত্রকলা বহুলাংশে প্রকৃতিনির্ভর; গাছ, লতাপাতা, ফুল-ফল, পদ্মরাজি শোভিত নদীনালা, ঘন মেঘ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির জল রাজপুত চিত্রকে জীবন্ত করে তোলে। ব্যক্তিমানুষকে রাজস্থানী ছবি অবান্তর বলে মনে করেছিল। কিন্তু আনন্দ-চঞ্চল পশু-পাখির ছবিগুলিতে তুলে ধরা হয়েছিল গীতিকাব্যের মাধুর্য। রাজস্থানী চিত্রে ধরা পড়ে মহাকাব্যের বিভিন্ন ঘটনা—ভীষ্মের শরশয্যা, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, যুধিষ্ঠীরের পাশাখেলা ইত্যাদি। পূর্বে উল্লেখিত ধর্মীয় ও লৌকিক কাহিনীগুলি ছাড়াও রাজস্থানী প্রতিকৃতি চিত্রে ফুটে ওঠে বীরোচিত তেজ, নারীর সৌন্দর্য ও প্রেমের আমেজ।
কৃষ্ণের জীবনের নানা ঘটনা এবং রাধাকৃষ্ণের প্রেম ও বিরহ-মিলন নিয়ে আঁকা হয়েছিল অসংখ্য রাজস্থানী চিত্র। রাগমালা বিভিন্ন রাগ-রাগিনী নিয়ে আঁকা ছবি রাজস্থানী চিত্রকলায় স্থান পেয়েছিল। ষড়ঋতুর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য (‘বারমাস্যা’ বা বারোমাসের কাহিনী) রাজপুত চিত্রকররা তাঁদের প্রিয় বিষয় হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। এককথায়, রাজস্থানী চিত্র ছিল লৌকিক ভাবপ্রধান; জীবনের ওঠা-পড়া, সুখ-দুঃ খ, হাসি-কান্না রাজস্থানী চিত্রকে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিনতার গতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছিল রাজস্থানী চিত্রকলায় শিল্পীকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। কে বা কারা এইসব ছবি এঁকেছিলেন তার হদিশ পাওয়া যায়। না। রাজস্থানী শিল্পে শিল্পী কখনও শিল্পকে অতিক্রম করে যাননি, এখানেও রাজস্থানী চিত্রকলা মুঘল চিত্রকলা থেকে অনেকটাই আলাদা।