মহারাজা বিশ্বসিংহের মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র মরনারায়ণ সিংহাসনে আরোহণ করেন। নরনারায়ণের রাজত্বকালই কোচরাজশক্তির বিকাশের চূড়ান্ত অধ্যায়। কোচবিহার তখন আর আঞ্চলিক রাজশক্তি নয়, সর্বভারতীয় রাজনৈতিক মঞ্চে তার প্রবেশ ঘটেছে। নরনারায়ণ নিজ নামে স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রার প্রবর্তন করেন, ওই মুদ্রা তাঁর নাম অনুসারে ‘নারায়ণী’ মুদ্রা নামে পরিচিত হয় এবং ব্রিটিশ যুগ পর্যন্ত প্রান্তিক উত্তরবঙ্গে, অসমে ও ভুটানে এই মুদ্রার ব্যবহার চলতে থাকে।
‘আকবর-নামা’র সাক্ষ্যে দেখা যায় নরনারায়ণের রাজ্যের উত্তর সীমানা ছিল তিব্বত। একথা সত্য হলে বুঝতে হবে ভুটানের রাজা কোনো-না-কোনোভাবে নরনারায়ণের বশ্যতা স্বীকার করে করদ রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। 1630 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভুটান রাজগণ যে কোচবিহার রাজাকে কর প্রদান করত, তার প্রমাণ রয়েছে। বীর মহারাজ বীরনারায়ণের রাজত্বকালে ভুটানরাজ এই কর প্রদান বন্ধ করলেও আরও কিছুকাল পর্যন্ত এই প্রথা রক্ষার খাতিরে বার্ষিক উপঢৌকন পাঠাতে থাকে। নরনারায়ণের আমলে কোচরাজ্য করতোয়া নদীর পশ্চিম পাড়ে ত্রিহূত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। ‘আকবর-নামা’য় সেকথা বর্ণিত আছে। কিন্তু ঠিক কোন সময়ে তিনি এদিকে রাজ্যবিস্তার করেন, সে বিষয়ে সঠিক জানা যায় না। যাইহোক, উত্তরে কোচরাজ্যের ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধি গৌড়ের পক্ষে বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। তাই 1568 খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের সুলতান কোচরাজ্য আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। এই সংবাদ পেয়ে মহারাজ নরনারায়ণ কনিষ্ঠ ভ্রাতা গুরুধ্বজের সৈন্যাপত্যে এক বিরাট বাহিনী গৌড় আক্রমণে প্রেরণ করেন। কিন্তু সুলেমান করোরানীর ইতিহাস-বিখ্যাত পরাক্রান্ত সেনাপতি কালাপাহাড়ের কাছে গুরুধ্বজ পরাজিত হন এবং তাঁর সৈন্যবাহিনীর অধিকাংশই বিধ্বস্ত হয়। কালাপাহাড়-এর পরে অসম আক্রমণ করেন এবং বিজয়ী বাহিনী নিয়ে তেজপুর পর্যন্ত অগ্রসর হন। পথে তিনি কামরূপ-কামাক্ষ্যা মন্দির এবং আরও অনেক হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেন। কালাপাহাড়ের এই বিজয় অভিযান রাজ্যজয়ের জন্য নয়, বরং ধ্বংস ও লুণ্ঠনের নেশায়। সে নেশা নিবৃত্ত হলে তিনি গৌড়ে ফিরে আসেন।
কিন্তু কালাপাহাড়ের এই বিধ্বংসী আক্রমণের ফলে কোচরাজ্যের পূর্ব সীমানায় যে রাজনৈতিক শূন্যতা বা দুর্বলতার সৃষ্টি হয়, কোচরাজ নরনারায়ণ তার সুযোগ গ্রহণ করেন। সেনাপতি গুরুধ্বজের নেতৃত্বে তিনি এক বিরাট বাহিনী পূর্বদেশীয় রাজ্য দখলে প্রেরণ করেন। 1572 খ্রিস্টাব্দে সুলেমান করোরানীর আকস্মিক মৃত্যু হওয়ায় গৌড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। সেই সময়ে নরনারায়ণ অসমের রাজা সুখাং গ্রাফা-র বিরুদ্ধে আক্রমণ করেন। সুখাং গ্রাফার সৈন্যদলের সঙ্গে গৌহাটির নিকট কোচ-সৈন্যদের জলে-স্থলে ভীষণ যুদ্ধ হয়। অসমরাজ এই যুদ্ধে পরাস্ত হলে নরনারায়ণ গৌহাটি, নীলাচল পর্বত, দরং, বেলতলী প্রভৃতি স্থান দখল করে নেন এবং আরও উত্তর-পূর্বদিকে অগ্রসর হন। চূড়ান্ত বিপদ বুঝে সুখাং গ্রাফা নরনারায়ণের সঙ্গে সন্দ্বি করেন। এই সন্দ্বির শর্ত অনুযায়ী সৌমার উপত্যকার পশ্চিমাংশ নরনারায়ণকে ছেড়ে দিতে তিনি বাধ্য হন। 1774 খ্রিস্টাব্দে বিহারপ্রদেশের অধিকার নিয়ে সম্রাট আকবরের সঙ্গে গৌড়ের সুলতান দাউদ খাঁর বিরোধ বাধে। ওই বছর ১ আগস্ট স্বয়ং আকবর বহু সংখ্যক রণতরী, রণহস্তী ও কামান নিয়ে অগ্রগামী মুঘল সেনাপতি মুনিম খাঁর সঙ্গে মিলিত হয়ে দাউদ খাঁর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। দূরদর্শী কূটনীতিবিদ নরনারায়ণ এই সময় মুঘল সম্রাটের সঙ্গে সামরিক আঁতাতে মিলিত হন এবং আকবরের অনুরোধে বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে অপরদিক থেকে গৌড়রাজা আক্রমণ করেন। দ্বিমুখী আক্রমণে ক্রমাগত পরাজয়ে বিতাড়িত হয়ে মুনিম খাঁ ওড়িশার দিকে পলায়ন করেন। মুঘল সেনাপতি মুনিম খাঁ গৌড়ের রাজধানী দখল করলেন। আর এদিকে নরনারায়ণ গঙ্গাতীর পর্যন্ত সমস্ত উত্তরবঙ্গ দখল করেন সামরিক আঁতাতভুত্ত বন্ধুরাষ্ট্রে কোচবিহারের এই রাজ্যবৃদ্ধি সম্রাট আকবর মেনে নিয়েছিলেন।
এই সামরিক আঁতাতের ফলে মুঘল সাম্রাজ্য কোচরাজ্যের পশ্চিম ও দক্ষিণ সীমানা রূপে পরিণত হওয়ার সেদিক থেকে সামরিক বিপদের সম্ভাবনা ছিল না। অন্যদিকে কর প্রদায়ী ভুটানরাজের দিক থেকে আক্রমণেরও সম্ভাবনা ছিল না। অতএব নরনারায়ণ এবার পূর্বদিকে আরও রাজ্যবিস্তারে মেতে ওঠেন। তিনি একে একে কাছাড়, মণিপুর, জয়ন্তীয়া এবং শ্রীহট্ট দখল করেন। অনেকের মতে, তিনি ত্রিপুরাও দখল করেছিলেন। ‘আকবর-নামা’য় কোচরাজ্যের সীমার যে বর্ণনা আছে, তাতে দেখা যায় এই রাজ্য পশ্চিমে ত্রিহত (মিথিলা), উত্তরে তিব্বত, দক্ষিণে কোড়াঘাট এবং অসম-পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই রাজ্যের দৈর্ঘ্য 200 ক্লোশ (800 মাইল) এবং প্রশ্নে 40 থেকে 100 ক্রোশ (অর্থাৎ 160 থেকে 400 মাইল) পর্যন্ত ছিল। নরনারায়ণ এই বিস্তৃত রাজ্য একা ভোগ করেননি, তিনি জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে পশ্চিমভূমির শাসনকর্তা নিয়োগে করেন এবং পূর্বভূমির (কামরূপসহ অসম অঞ্চল) শাসনকার্য কনিষ্ঠ ভ্রাতা গুরুধ্বজের হাতে অর্পণ করেন। কোচরাজ্যের বিস্তারে সেনাপতি গুরুধ্বজের ভূমিকা ও কৃতিত্বই সর্বাধিক। তাঁর মতো কুশলী যোদ্ধা এবং সফল সেনাপতি কোচরাজবংশে কেউ কখনও জন্মাননি |