রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে মার্কসীয় মতবাদ:
মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি মানব সমাজের একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া, যা মূলত শ্রেণী সংগ্রামের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে। মার্ক্সবাদী তত্ত্ব অনুসারে, রাষ্ট্রের ভূমিকা হচ্ছে শোষক শ্রেণির শোষণ ও শাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং এটি শোষিত শ্রেণীকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহৃত হয়। মার্ক্স ও এঙ্গেলসের মতে, প্রাথমিক সমাজ ছিল শ্রেণীহীন, যেখানে মানুষের মধ্যে কোন ধরনের শ্রেণী বিভাজন ছিল না। তবে প্রাকৃতিক উৎপাদন শক্তি এবং কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পদ ও ক্ষমতার বিভাজন শুরু হয়, যার ফলে শ্রেণী বিভাজন তৈরি হয় এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা উদ্ভূত হয়।
১. প্রাথমিক সমাজে শ্রেণীহীনতা
মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, প্রাথমিক সমাজ ছিল কমিউনিস্ট বা শ্রেণীহীন। এখানে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা ছিল না, এবং সমস্ত সম্পদ সমাজের সকল সদস্যের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হত। মানুষের জীবনযাত্রা ছিল প্রাকৃতিক এবং যৌথ, এবং তারা একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করত। এই সমাজে রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব ছিল না, কারণ এখানে শোষণ বা শ্রেণী বিভাজনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এই ধরনের সমাজকে “প্রাচীন কমিউনিস্ট সমাজ” বলা হয়।
২. উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন ও শ্রেণী বিভাজন
কৃষি বিপ্লবের পর, যখন মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করল এবং জমি চাষের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন করার পাশাপাশি অতিরিক্ত সম্পদ তৈরি করতে শুরু করল, তখন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পদের সংরক্ষণ এবং মালিকানার ধারণা জন্ম নেয়। এর ফলে সম্পত্তি, শ্রেণী এবং ক্ষমতার মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়। সমাজে শোষিত শ্রেণী (প্রোলেতারিয়েট) এবং শোষক শ্রেণী (বুর্জোয়া) গড়ে ওঠে। এই শ্রেণী বিভাজনের ফলে একটি শোষণমূলক কাঠামো তৈরি হয়, যা রাষ্ট্রের উত্থানের অন্যতম কারণ।
৩. রাষ্ট্রের উত্থান
মার্ক্সীয় তত্ত্ব অনুসারে, রাষ্ট্রের জন্ম শ্রেণী সংগ্রামের ফলস্বরূপ। যখন একটি সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী তৈরি হয় এবং তাদের মধ্যে শোষণ ও বিরোধ শুরু হয়, তখন শাসক শ্রেণী তাদের শাসন এবং শোষণ টিকিয়ে রাখতে একটি বাহ্যিক শক্তি হিসেবে রাষ্ট্র গঠন করে। রাষ্ট্রের মূল কাজ শোষিত শ্রেণীকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং শোষক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করা। রাষ্ট্র, সেসময়ে, সামাজিক অস্থিতিশীলতা ও বিরোধের মধ্যে একটি কেন্দ্রীকৃত শক্তি হিসেবে কাজ করে, যা শোষিত শ্রেণীকে দমন করে।
৪. রাষ্ট্রের ভূমিকা
মার্ক্সের মতে, রাষ্ট্র শোষক শ্রেণীর স্বার্থে কাজ করে এবং তাদের শোষণ প্রক্রিয়াকে বৈধতা প্রদান করে। প্রাথমিক পর্যায়ে, রাষ্ট্র মূলত শোষণকারী শ্রেণীর (বুর্জোয়া) শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে এবং তাদের সামরিক, আইনগত এবং প্রশাসনিক শক্তি ব্যবহার করে শোষিত শ্রেণী (প্রোলেতারিয়েট) এর ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখে। রাষ্ট্র শাসকের পক্ষ থেকে আইন প্রণয়ন, কর আদায় এবং সামরিক শক্তি ব্যবহার করে তাদের শোষণ ক্ষমতা ধরে রাখে।
৫. রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ
মার্ক্সের চিন্তাভাবনায়, রাষ্ট্র একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার অংশ, যার শেষ পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজে রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটে। মার্ক্সের মতে, যখন শ্রমিক শ্রেণী (প্রোলেতারিয়েট) ক্ষমতা দখল করে, তখন শোষক শ্রেণী বিদায় নেবে এবং শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। এই সমাজে রাষ্ট্রের কোনও প্রয়োজন থাকবে না, কারণ এখানে শোষণ থাকবে না এবং সকলের মধ্যে সমতা ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রের কাঠামো তখন স্বাভাবিকভাবে বিলীন হয়ে যাবে এবং একটি মুক্ত, শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।
৬. শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন
মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মূল লক্ষ্য হচ্ছে শোষণহীন সমাজ গঠন করা। যখন রাষ্ট্র শ্রেণী সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠে, তখন সে শোষিত শ্রেণীকে দমন করে। তবে একসময় শ্রমিক শ্রেণী (প্রোলেতারিয়েট) যখন নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করবে এবং শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে, তখন রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা শেষ হবে। মার্ক্সের মতে, সমাজে সমস্ত শ্রেণী বিভাজন বিলীন হয়ে যাবে এবং রাষ্ট্রের কার্যকারিতা ধীরে ধীরে অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে।
উপসংহার
মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, রাষ্ট্রের উৎপত্তি হলো সমাজের শ্রেণী সংগ্রামের ফলস্বরূপ। এটি শোষক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় এবং শোষিত শ্রেণীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য গড়ে ওঠে। তবে সমাজে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা বিলীন হয়ে যাবে, এবং একটি শ্রেণীহীন সমাজে রাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা থাকবে না।