সার্বভৌমত্ব বলতে কি বোঝানো হয়?
সার্বভৌমত্ব হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি মৌলিক ধারণা, যা রাষ্ট্রের চূড়ান্ত এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতাকে নির্দেশ করে। সার্বভৌমত্বের ধারণা অনুযায়ী, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নিজস্ব ভূখণ্ড, জনগণ এবং শাসন ব্যবস্থার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং সে অন্য কোনো রাষ্ট্রের অধীন নয়।
মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ:
- সর্বোচ্চ ক্ষমতা: রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোনো কর্তৃত্ব তার চেয়ে ঊর্ধ্বে নয়।
- স্বাধীনতা: বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত।
- সীমাবদ্ধহীন কর্তৃত্ব: রাষ্ট্র তার নিজস্ব আইন এবং সিদ্ধান্ত প্রণয়নে সম্পূর্ণ স্বাধীন।
জ্যঁ বদিন (Jean Bodin) এবং থমাস হবস (Thomas Hobbes) সার্বভৌমত্ব তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা। বদিনের মতে, সার্বভৌমত্ব হলো রাষ্ট্রের “অবিচ্ছিন্ন এবং চূড়ান্ত ক্ষমতা”।
সার্বভৌমত্বকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়:
- অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব: রাষ্ট্রের নিজস্ব ভূখণ্ডের ভেতরে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ।
- বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব: অন্য রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা।
সার্বভৌমত্বের বহুত্ববাদী তত্ত্ব
বহুত্ববাদী তত্ত্ব হলো সার্বভৌমত্বের একটি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি, যা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ও একক ক্ষমতার ধারণার বিরোধিতা করে। বহুত্ববাদীরা মনে করেন যে, আধুনিক সমাজে সার্বভৌমত্ব কেবল রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠীরও ক্ষমতা থাকে এবং তাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বহুত্ববাদী তত্ত্বের প্রধান ধারণা
- রাষ্ট্রের একচেটিয়া ক্ষমতার বিরোধিতা:
বহুত্ববাদীরা মনে করেন, সার্বভৌমত্বকে যদি একক এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতা হিসেবে ধরা হয়, তাহলে এটি সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠীর ভূমিকা অবমূল্যায়ন করে। - বিভিন্ন গোষ্ঠীর ক্ষমতা:
আধুনিক সমাজে বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী থাকে, যারা নিজেদের নিয়ম-নীতি মেনে চলে এবং সমাজে ক্ষমতা প্রয়োগ করে। উদাহরণস্বরূপ:- শ্রমিক ইউনিয়ন
- ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান
- ব্যবসায়ী সংগঠন
- ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ:
রাষ্ট্রের ক্ষমতা এককেন্দ্রিক নয়; এটি সমাজের বিভিন্ন স্তরে ভাগ হয়ে যায়। স্থানীয় সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং নাগরিক সমাজ রাষ্ট্রের পাশাপাশি ক্ষমতার অংশীদার। - ব্যক্তিস্বাধীনতার গুরুত্ব:
বহুত্ববাদী তত্ত্ব ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বাধীনতাকে রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। তারা মনে করেন যে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা যদি সীমাহীন হয়, তবে তা ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।
বহুত্ববাদী তত্ত্বের প্রবক্তাগণ
১. হ্যারল্ড জে লাস্কি (Harold J. Laski):
লাস্কি বহুত্ববাদী তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা। তার মতে, রাষ্ট্রের চেয়ে সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, “মানুষ কেবল রাষ্ট্রের নাগরিক নয়, বরং একাধিক গোষ্ঠীর সদস্য“।
২. গিডিংস (Giddings):
গিডিংস মনে করেন, সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ভারসাম্য ও সমন্বয়ই প্রকৃত সার্বভৌমত্ব সৃষ্টি করে।
৩. জর্জ কোল (George Cole):
কোলের মতে, আধুনিক সমাজে রাষ্ট্রের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করা উচিত, যাতে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষিত থাকে।
বহুত্ববাদী তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য
- গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজ:
সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান, যারা নিজেদের মধ্যে স্বাধীনভাবে কাজ করে। - ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ:
রাষ্ট্রের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না হয়ে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত। স্থানীয় সরকার ও বেসরকারি সংগঠনের ক্ষমতা স্বীকৃত। - ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অধিকার:
রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অধিকার খর্ব করতে পারে না। - গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ:
বহুত্ববাদ গণতন্ত্রকে উৎসাহিত করে, যেখানে বিভিন্ন মত ও বিশ্বাসের সহাবস্থান থাকে। - রাষ্ট্রের সীমিত ভূমিকা:
রাষ্ট্রের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ রেখে সমাজের অন্যান্য গোষ্ঠীকে স্বাধীনতা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বহুত্ববাদী তত্ত্ব তুলে ধরে।
বহুত্ববাদী তত্ত্বের গুরুত্ব
- গণতন্ত্রের বিকাশ:
বহুত্ববাদ গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ভিত্তি শক্তিশালী করে। এটি জনগণের মতামত এবং গোষ্ঠীগত চাহিদাকে গুরুত্ব দেয়। - স্বাধীনতার সুরক্ষা:
ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর স্বাধীনতা রক্ষা করে রাষ্ট্রের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ রাখে। - সমাজের ভারসাম্য:
বিভিন্ন গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি হয়, যা একটি সুস্থ সমাজের জন্য অপরিহার্য। - কেন্দ্রীভূত শাসনের বিরোধিতা:
এটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরোধিতা করে এবং বিকেন্দ্রীকরণকে উৎসাহিত করে।
বহুত্ববাদী তত্ত্বের সমালোচনা
- রাষ্ট্রের ক্ষমতা অবমূল্যায়ন:
বহুত্ববাদ রাষ্ট্রের ক্ষমতার গুরুত্বকে অস্বীকার করে, যা একটি সুসংহত সমাজব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয়। - নৈরাজ্যের সম্ভাবনা:
বিভিন্ন গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত স্বাধীনতা নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে। - জাতীয় ঐক্যের অভাব:
রাষ্ট্রের চেয়ে গোষ্ঠীগত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিলে জাতীয় ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। - দুর্বল রাষ্ট্র ব্যবস্থা:
রাষ্ট্রের ক্ষমতা সীমিত হলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে পড়ে।
উপসংহার
সার্বভৌমত্বের বহুত্ববাদী তত্ত্ব আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। এটি রাষ্ট্রের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা এবং ব্যক্তির স্বাধীনতা ও গোষ্ঠীর ভূমিকার ওপর জোর দেয়। যদিও এই তত্ত্ব রাষ্ট্রের শক্তিকে কিছুটা কমিয়ে দেয় বলে সমালোচিত, তবে এটি গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার সুরক্ষায় একটি কার্যকর দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। আধুনিক বিশ্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার এবং নাগরিক সমাজের বিকাশ এই তত্ত্বের বাস্তব প্রতিফলন।