স্থাপত্য, ভাস্কর্য স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা কিভাবে ইতিহাস রচনায়  আমাদের সাহায্য করে? প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় মুদ্রা ও স্থাপত্য-ভাস্কর্যের গুরুত্ব আলোচনা করো?

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় মুদ্রা ও স্থাপত্য-ভাস্কর্যের গুরুত্ব :

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের মধ্যে মুদ্রা ও স্থাপত্য-ভাস্কর্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সাহিত্য ও লিপি থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যায় মুদ্রা ও স্থাপত্য-ভাস্কর্য সেগুলির সত্যতা নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মুদ্রা ঃ মুদ্রা হলো নির্দিষ্ট একটি ধাতুখন্ডের উপর নির্দিষ্ট ওজন এবং শাসকের ছাপ যুক্ত বস্তু যা বিনিময়ের কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রাচীন যুগে সোনা, রুপা, তামা প্রভৃতি ধাতুর মুদ্রা প্রচলিত ছিল। প্রাচীন ভারতের রাজারা সিংহাসনে আরোহন, কোন শত্রুকে পরাজিত করা প্রভৃতি ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মুদ্রার প্রচলন করতেন।

বিভিন্ন যুগের মুদ্রা ঃ ভারতের প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার কোন মুদ্রা পাওয়া যায়নি। বৈদিক যুগে মনা ও নিষ্ক নামে দুই ধরনের স্বর্ণমুদ্রার কথা জানা যায়। কিন্তু সে যুগে মুদ্রার ব্যবহার খুব কম ছিল। তবে গ্রীকদের প্রভাবে ভারতে মুদ্রা প্রচলন রীতি বিস্তার লাভ করে। মৌর্য-পরবর্তী যুগে ব্যাকট্রীয় গ্রিকদের  মাধ্যমে ভারতে সন-তারিখযুক্ত মুদ্রা প্রচলিত হয়েছিল। হুবিষ্ক, বাশিষ্ক, কনিষ্ক-সহ একাধিক কুষাণ রাজার নাম ও রাজত্বকালের কথা সেই সময়ে প্রচলিত মুদ্রা থেকেই জানা যায়। সে যুগের মুদ্রা থেকে রোম-ভারত বাণিজ্যের প্রমাণ মেলে। এছাড়া ব্যাকট্রীয় গ্রিক, শক এবং সাতবাহন রাজাদের বিভিন্ন কার্যকলাপের ইতিহাস মুদ্রা থেকে পাওয়া যায়। গুপ্ত যুগের প্রাপ্ত মুদ্রায় একাধিক দেবদেবীর মূর্তি, রাজাদের মূর্তি ছাড়াও সমুদ্রগুপ্তের বিনাবাদনরত মূর্তি পাওয়া গেছে। এ যুগের স্বর্ণমুদ্রা থেকে সমকালীন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পরিচয় মেলে। তবে গুপ্ত-পরবর্তী যুগের ভারতে মুদ্রার প্রচলন অনেক কমে গিয়েছিল।

মুদ্রার গুরুত্ব :- প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় মুদ্রার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। মুদ্রা থেকে ইতিহাস রচনার বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। যেমন –

•মুদ্রা থেকে বিভিন্ন রাজার নাম, ছবি এবং সিংহাসন আরোহণকালের পরিচয় পাওয়া যায়।

•মুদ্রায় দেবদেবীর মূর্তি থেকে ধর্মীয় জীবনের পরিচয় মেলে।

•মুদ্রায় অঙ্কিত বাদ্যযন্ত্র, অলংকার, পোশাক প্রভৃতি থেকে সে যুগের সমাজ জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়।

•অর্থনৈতিক ইতিহাস রচনাতেও মুদ্রার গুরুত্ব রয়েছে। স্বর্ণমুদ্রা থেকে আর্থিক সমৃদ্ধি এবং খাদযুক্ত মুদ্রা থেকে আর্থিক অবনতির কথা জানা যায়।

•একটি মুদ্রার ওপর অন্য রাজার ছাপ থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রথম রাজা দ্বিতীয় রাজার দ্বারা পরাজিত হয়েছিলেন।

•  মুদ্রা থেকে রাজাদের রাজ্যসীমা, বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যেকার বাণিজ্য প্রভৃতির বিবরণ পাওয়া যায়। সুতরাং বলা যায়, প্রাচীন ভারতের সুসংবদ্ধ ইতিহাস রচনায় মুদ্রা সাহায্য করে।

স্থাপত্য-ভাস্কর্য : প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের মাধ্যমে মাটির নীচ থেকে প্রাচীন যুগের বিভিন্ন প্রাসাদ, মন্দির, চিত্রকলা প্রভৃতিও আবিষ্কৃত হয়েছে। এই বিষয়গুলিকে স্থাপত্য-ভাস্কর্য উপাদান বলা হয়। এই উপাদান প্রাক্-ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস জানা যায়।

     উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য-ভাস্কর্য ঃ স্থাপত্য-ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে বেলুচিস্তানের মেহেরগড় সভ্যতার কথা প্রথম বলতে হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ বছরের পুরনো এই সভ্যতা ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যের ফলে প্রাপ্ত ঘরবাড়ি, হাতিয়ার, সিলমোহর প্রভৃতি থেকে মেহেরগড় সভ্যতার বিবরণ পাওয়া যায়।

     এরপরে আসে সিন্ধু সভ্যতা। এই সভ্যতার বিবরণ শুধু খননকার্য থেকে প্রাপ্ত স্থাপত্য-ভাস্কর্য থেকেই পাওয়া গেছে। অনুরূপভাবে পাটলিপুত্র, হস্তিনাপুর, তক্ষশীলা প্রভৃতি অঞ্চলে খননকার্য চালিয়ে প্রাচীন যুগের ইতিহাসের বিভিন্ন নিদর্শন পাওয়া গেছে।

উপরোক্ত বিষয়গুলি ছাড়াও মৌর্য যুগের সময় থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে বহু সৌধ, স্মৃতিস্তম্ভ, প্রাসাদ, মন্দির প্রভৃতি নির্মিত হয়েছিল। এগুলি থেকে সংশ্লিষ্ট রাজাদের আমলের ইতিহাস জানা যায়। যেমন – সাঁচি ও সারনাথের বৌদ্ধস্তূপ, অজন্তা ও ইলোরার গুহাচিত্র, পল্লব ও চোল যুগের মন্দির স্থাপত্য প্রভৃতি। এইসব উপাদান প্রাচীন ভারতের ধর্ম ও সাংস্কৃতিক জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছে।

মূল্যায়ন : সবশেষে বলা যায় যে, মুদ্রা যেমন কোন অঞ্চলের আর্থিক সমৃদ্ধি, ধর্মীয় জীবনের পরিচয় দেয় তেমনই স্থাপত্য-ভাস্কর্য সেসময়ের সাংস্কৃতিক জীবনের পরিচয় তুলে ধরে। তাই বলা যায় প্রাচীন ভারতের ইতিহাসকে পরিপূর্ণ করে তুলতে মুদ্রা ও স্থাপত্য-ভাস্কর্যের ভূমিকা অপরিসীম।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading