হুসেন শাহীর শাসন আমলে বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনের বিবরণ দাও। Give an account of the cultural life of Bengal during the rule of Hussain Shahi

হুসেন শাহী বংশের শাসন বাংলার শিক্ষা-সংস্কৃতির ইতিহাসে এক গৌরবজ্জ্বল অধ্যায়রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই যুগে বাঙালি প্রতিভার অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটে স্থানীয় মনীষীর ভিত্তিতে বাংলা সাহিত্যের নব জাগরণ ঘটে এই যুগে। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার-এর ভাষায়- “It was a period in which the vernacular found its due recognition as the literary medium through which the repressed intellect of Bengal was to find its release.” এই জাগরণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং এর মূলে ছিল পৌরাণিক আখ্যানের প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধাবোধ এবং সুলতান হুসেন শাহ ও নসরত শাহ-র আন্তরিক পৃষ্ঠপোষকতা। এই যুগে প্রথম ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’ সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনূদিত হয়। সুলতানি কর্মচারী রূপ গোস্বামী রচনা করেন ‘বিদগ্ধ মাধব’ ও ‘ললিত মাধব’ নামক দুটি অমূল্য গ্রন্থ। মালাধর বসু শ্রীমদ্ভাগবতের বাংলা অনুবাদ করেন। তাঁকে উৎসাহিত ও সম্মানিত করার জন্য শাহ তাঁকে ‘গুণরাজ খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগল খাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় পরমেশ্বর সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় ‘মহাভারত’ অনুবাদ করেন। পরাগল খাঁর পুত্র ছুটী খাঁর আনুকূল্যে মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বের অনুবাদ করেন শ্রীকর নন্দী। আবার রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই বিজয় গুপ্ত, বিপ্রদাস প্রমুখ ‘মনসামঙ্গল’ কাব্য রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। বাংলা ভাষার সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃত, সাহিত্য ও দর্শন চর্চাও সে যুগে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই যুগে হস্তলিখন পদ্ধতিও যথেষ্ট উৎকর্ষতা লাভ করে। অধ্যাপক তরফদার বলেছেন- “The art of writings seems to have attained a considerable degree of perfection in the Hussain Shahi period.”

হুসেন শাহী বংশের রাজত্বকালে মানবতাবাদী ও ভাবসর্বস্ব কাব্যেরও বিশেষ উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। ভক্তিবাদী আন্দোলনের সৈনিক শ্রীচৈতন্য শুধ যে ভক্তিবাদকে জনিপ্রয় করে তুলেছিলেন তাই নয়, বাংলা সাহিত্যের বিকাশেও তাঁর অবদান ছিল অনন্য। শ্রীচৈতন্যর ‘জীবনচরিত’ গুলি দেশীয় সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি করে। সুলতানদের ধর্মীয় উদারতা বঙ্গীয় ধর্মজীবনে বয়ে আনে নতুন আস্বাদ। গোঁড়ামিমুক্ত, আড়ম্বরহীন, বৈষম্যহীন চৈতন্যবাদ সহজেই তার পথ খুঁজে পায় বাংলার মাটিতে। ‘History of Bengal’-এ বলা হয়েছে- “It is impossible to conceive of the rise and progress of Vaisnavism or the development of Bengali literature at this period without recalling to mind the tolerant and enlightened rule of the Musslim Lord of Gour.” চৈতন্যের জীবন ও বাণী বাঙালির চিন্তা ও জীবনে আনে নতুন বিপ্লব। নাথ, ধর্মঠাকুর প্রভৃতি অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসেরও বিশেষ প্রসার দেখা যায় এই যুগে।

স্থাপত্য শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রেও হুসেন শাহী বংশের অবদান অনস্বীকার্য। হিন্দু ও ইসলামীয় রীতির সংমিশ্রণে এই যুগে অপূর্ব মন্দির ও মসজিদ নির্মিত হয়। এগুলির মধ্যে ইড়ো সোনা মসজিদ, কদম রসুল, ছোটো সোনা মসজিদ, ‘একলাখি সমাধি মন্দির’, তাঁতী পাড়া মসজিদ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ইট ও পাথর দ্বারা নির্মিত এই সব মন্দিরে প্রাদেশিক উতির প্রভাব লক্ষণীয়।

ধর্ম বিষয়ে হুসেন শাহী সুলতানদের উদারতা হিন্দু-মুসলমান বিরোধকে প্রশমিত করে উভয় সংস্কৃতির সমন্বয়সাধনের পথকে প্রশস্ত করেছিল। ধর্মীয় বিচ্ছেদের পরিবর্তে বাঙ্গালির ভাষাগত ঐক্যের বন্ধন দৃঢ় হয়েছিল।

এইভাবে হুসেন শাহী বংশের সুশাসনে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষিত হয়েছিল। পরিধিগত আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছিল, শাসনব্যবস্থা সুদৃঢ় হয়েছিল এবং ধর্ম, সংস্কৃতি ও আর্থিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল। অধ্যাপক তরফদার-এর ভাষায়- “Hussain Sahi rule in Bengal was characterised by the territorial expansion…. stabilization of administration and certain significant development in respect of religion literature arts and economy.”

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading