১৮১৭ সালে কয়েকটি সাধারণ ইংরেজ পল্টনের দ্বারা ঘুম ভাঙ্গল প্রায় এক হাজার বছর ধরে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন অজন্তার। ভারতে কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস বিজরিত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আর্ট গ্যালারী শিল্প জগতের রানী আবিস্কৃত হল পথ হারা ইংরেজ পল্টনের দ্বারা এতদিনে অজন্তা এসে দাঁড়াল সভ্য জগতের কাছে। অজন্তা কোন স্বাভাবিক পর্বত গুহা নয়। পাহাড় যেমন আপনা থেকে প্রাকৃতিক খেয়ালে গুহা তৈরি হয়, তেমন কোন গুহা নেই অজন্তায়। সব গুহা পাথর কেটে। সব মিলিয়ে তিরিশটি গুহা পাওয়া যায়। ভারতের বৌদ্ধ বিহারগুলির মধ্যে অজন্তার স্থান সর্ব উচ্চে।
অজন্তা গুহাচিত্রে স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা, শিল্পের এই তিনটি শাখার একত্রে প্রকাশ ঘটে। জলগাঁও ষ্টেশন হতে ৬০ মাইল এবং ঔরঙ্গাবাদ শহর হতে ৫৫ মাইল দূরে অজন্তা গুহা চিত্র মহারাষ্ট্র প্রদেশের অন্তর্গত। বি মিলিয়ে তিরিশটা গুহা পাওয়া যায়। তিরিশটির মধ্যে প্রধানতম গুহা মন্দির দশম চৈত্য। পাঁচটি গুহা ব্যবহার করা হত উপাসনাগৃহ রূপে। বাকী পাঁচটি হল সখারাম। এই গুহাগুলিতে থাকতেন বৌদ্ধ শ্ৰমণরা। প্রথম দুটি গুহা খােদাই করে বৌদ্ধ শ্ৰমণদের আবাসভূমি তৈরী করা হয়। কাজ শেষ হয় দ্বিতীয় খৃষ্ট শতকে। দ্বিতীয় খৃষ্ট শতক থেকে সপ্তম শতক ধরে একের পর এক তৈরী হল গুহা ও চৈত্য। এল খােদইকারের দল। সাত আট বছর ধরে চলল গুহা খোদাইয়ের কাজ।
এই ভাবেই খোদাইকার, চিত্রকর ও রঙ শিল্পীরা একত্রে চিত্রে সজ্জিত করল অজন্তার গুহাকে। দেওয়ালে আঁকা ফ্রেস্কোগুলির (দেওয়াল চিত্র) কমনীয়তা ও বর্ণাঢ্য সকলকে আকৃষ্ট করে। অজন্তার দেওয়াল চিত্রগুলি কিন্তু আমরা সাধারণ ভাবে ফ্রেস্কো বলে জানলেও বিশেষজ্ঞরা এর নাম “ফ্রেস্কো সেক্কো” বলে থাকেন। অজন্তার শুরু হীনযানদের হাতে। বুদ্ধ মহাপ্রয়ানের পর বৌদ্ধধর্ম দুভাগে ভাগ হয়। হীনযান এবং মহাযান। হীনযানরা বৌদ্ধমূর্তি আঁকতেন না। বুদ্ধকে বােঝাতে ইঙ্গিত ব্যবহার করতেন। যেমন একজোড়া পাদুকা আঁকলেন। পাদুকা দেখে বুঝতে হবে এ হল বুদ্ধের পাদুকা।
শূন্য সিংহাসন। এ দেখেবুঝে নিতে হবে বুদ্ধের সিংহাসন। চিত্রে সংখ্যার বিচারে অজন্তা বিস্ময়কর গুহা চিত্র। এত বিপুল চিত্র সম্ভার এঁকে তুলতে দরকার হয়েছে অসংখ্য শিল্পীর। এমন ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন ঘটে যাওয়াই হত স্বাভাবিক। কিন্তু আশ্চর্য তেমন কোন ঘটনা স্পর্শ করতে পারেনি অজন্তাকে। সব ছবি একই রকম, একই ধর্ম, একই রকম বিন্যাস আর একই অঙ্কন রীতি ব্যবহার করা হয়েছে।
বাঘােরা নদী থেকে প্রায় খাড়া হয়ে উঠে গেছে আড়াইশ ফুট পর্যন্ত। সব থেকে নীচের গুহা নদী থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ ফুট উঁচুতে। সব থেকে উপরের গুহা প্রায় একশত ফুট উপরে। ধাপে ধাপে সিঁড়ি কাটা। তার উপর বারান্দার মত সমতল ক্ষেত্র। এরপর শুরু হয়েছে গুহা মন্দিরের সারি। সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠলে প্রথমেই পড়ে ১ নম্বর গুহা। অবস্থান অনুযায়ী প্রথম গুহা মন্দিরের মুখে ছিল সুন্দর টানা বারান্দা আর ছিল স্তম্ভের সারি। অলঙ্করনে অপরূপ করে সাজান স্তম্ভের দেহ।
অলিন্দ পার হলেই গুহার প্রবেশ দ্বার। মাথা তুললেই ছাদ। ছাদের প্যানেলে নকশার বাহার। কত রকম আলপনা যে আঁকতে পারতেন অজন্তার শিল্পীরা। লীলায়িত রেখা এগিয়ে চলেছে স্রোতের ন্যায়। অথচ শিল্প সৃষ্টিতে কোথাও নেই পুনরাবৃত্তি। গাছ, পাতা, ফুলের ফাকে ফাকে নানা প্রকার অদ্ভুত জন্তুর যেন আনাগােনা। পরিচিতর মধ্যে হাতী, পাখী, ফুলের মালা, আম, বাতাবি লেবু, বেগুন এই সব দেখতে পাওয়া যায়। ১নং গুহায় চিত্রিত ছিল মত্ত যন্ডের লড়াই। দেখা যায় ‘অবলােকিতেশ্বর পদ্মপানি’ ছবির ভাব ব্যঞ্জনাকে মূর্ত করতে ভাষা পাওয়া কঠিন। এই ছবিটি বুদ্ধের জীবনে এক চরম মূহূর্তকে নিয়ে অঙ্কিত।
এই গুহায় ছিল সারি সারি হস্তীযুথ, শিকারের দৃশ্যে অসংখ্য মানুষের ছবি, আছে সিদ্ধার্থের সংসার ত্যাগের ছবি। রােগ, ভরা আর মৃত্যুর দৃশ্য সম্বলিত ছবি, কিছু বিদেশীর প্রতিকৃতি, দ্বিতীয় পুলকেশী, পারস্যের রাজা খসরু ভারতীয় দূতকে অভ্যর্থনা করছেন, রানী শিরীনের ছবি ইত্যাদি। বােঝা যায় এই সময় পারস্য ও ভারতের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ছিল। এ গুহায় আছে অলিন্দ সুন্দরী কৃষ্ণার ছবি। যৌবনা কৃষ্ণা অলংকারে সজ্জিত। শিল্পীরা প্রতিকৃতি অঙ্কনে যে দক্ষ ছিলেন এই চিত্রই তার নিদর্শন। | তৃতীয় ও পঞ্চম গুহাটি ছিল অসমাপ্ত। পঞ্চম গুহায় সিংহ, হস্তী প্রভৃতি আটটি জন্তু সম্বলিত দুটি মকর-বাহিনীর মূর্তি আছে। একমাত্র দ্বিতল গুহা হল ষষ্ঠ নং গুহাটি।
নকশার প্রাধান্যই এই গুহাটিতে। ষষ্ঠ ও সপ্তম গুহায় বিভিন্ন ছবি পাওয়া যায় যাদের নাম, “ধর্মোপদেশ দানরত বুদ্ধ”, “পূজার্থিনী ও দ্বারপালবৃন্দ”, “বুদ্ধ ও মার”, “ভিক্ষুক”, “দ্বারপাল, ও নরনারীর যুগল মূর্তি”, “শ্রাবন্তীর অনিমা”, “উদ্ভীমান গন্ধর্ব মূর্তি”, “বুদ্ধের জন্ম”ইত্যাদি। অষ্টমটি পরিত্যক্তা। নবম। ও দশম গুহা দুটি আবাসিক নয় উপাসনার জন্য “চৈত্য”। অনুমান করা হয় নবম গুহার দেওয়ালে দুবার করে ছবি অঙ্কিত হয়। প্রথম ছবির উপর দ্বিতীয় পর্যায় অঙ্কনের ফলে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
অজন্তার শ্রেষ্ঠ কম্পােজিশনটি এইরূপ সপরিবারে রাজা চলেছেন বােধিবৃক্ষ পূজা করতে। অনেকের মতে ইনি নাগরাজ। রাজার গলায় মালা, পাশে ছাতা। হাতে পুরুষ ও নারীর দল। যেন দৃষ্টি বােধিবৃক্ষের দিকে। দশম গুহার ছবিটির ষড়দন্ড জাতক থেকে অঙ্কিত। হাতীর পালের চিত্র এঁকেছেন। চিত্রে পরিপ্রেক্ষিত আরােপ সুন্দর ভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
অজন্তার ষােল নম্বর গুহায় অঙ্কিত আছে চিন্তামগ্ন ‘শুদ্ধোদন’। মাতৃবিয়ােগের পর মহা গৌতমীর মমত্ব চিত্রে বিদ্যমান। এছাড়াও গৌতমীকে নিয়ে পরামর্শ করছেন শুদ্ধোদন ও গােপা আর গৌতমীর ছবি (এগার থেকে পনের নম্বর গুহা মন্দির ছিল ছবিহীন) ছবি দেখলে বােঝা যায় আঁকবার বিষয় বস্তুগুলিকে শিল্পীরা ধ্যানযােগে দেখতেন। উপরােক্ত বিবরণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় রাজরাজাদের জীবনযাত্রা, সহযাত্রা ও নৃত্যগীতের ছবি সেই সঙ্গে ধর্মীয় বিষয় চিত্রের বিষয়বস্তু ছিল।
সতের নম্বর গুহাতেই আছে ভারতীয় শিল্পের আর এক বিস্ময়। এই গুহায় কিছু কৌতুক চিত্র দেখা যায়। এই গুহায় ছবিগুলিতে ঘননীল আকাশ, উত্তাল তরঙ্গময় সমুদ্র, বাতাস, ঝড়-এর দৃশ্য পাওয়া যায়। বীণা বাদক, বাঁশী বাদককে দেখতে পাওয়া যায় । অজন্তার গুহাগুলি এইভাবে ভাগ করেছেন বিভিন্ন পন্ডিতরা।
হীনযুগ, চৈত্য বা গুহা মন্দির ৯ ও ১০, বিহার সংখ্যা ৮, ১২, ১৩, ৩০। মহাযান যুগ, চৈত্য বা গুহা মন্দির সংখ্যা ১১, ১৬, ২৬, ২৭, ২৯। বিহার সংখ্যা ১ থেকে ৭, ১১, ১৫ থেকে ১৮, ২০ থেকে ২৫ ও ২৮।
অজন্তার ছবিগুলিতে সে যুগের ঘরবাড়ী, রাজসভা, রাজ অন্তপুর, রাজবাড়ীর দাসদাসী, সৈন্যসামন্ত, সভাসদ ও সাধু, সন্ন্যাসীদের কাপড়-চোপড়, নানা আসবাবপত্র প্রসাধন, যাত্রা যান দোকান, যুদ্ধ, সাধারণের জীবনযাত্রা সবই মনােরম ভাবে চিত্রে প্রকাশ করা হয়েছে। এই অসাধারণ ও বিস্ময়কর শিল্প শৈলীর নিদর্শন হল অজন্তা গুহা চিত্র।