‘অতিথি’ গল্পের নামকরণের অনুষঙ্গে তারাপদ চরিত্রের পরিচয় দাও।

আশাপূর্ণা দেবীর অতিথি’ গল্পটি মানব সম্পর্কের আন্তরিকতা, মায়া, স্নেহ, এবং সৌন্দর্যর প্রতি এক আত্মিক আকর্ষণের চিত্র তুলে ধরে। গল্পের প্রধান চরিত্র তারাপদ একটি ক্ষণস্থায়ী যাত্রার পথিক, যিনি এক স্থানে থেকে আরেক স্থানে চলে যান, এমনকি পারিবারিক বন্ধন থেকেও তিনি দূরে থাকেন। তার চরিত্রটি প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা, সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষণ, এবং পৃথিবীর প্রতি এক অন্তর্গত পিপাসা দ্বারা প্রভাবিত। তারাপদ একটি ‘অতিথি’—এক যে কোন এক স্থানে এসে ক্ষণিকের জন্য অবস্থান করে, আবার চলে যায়। এই একমাত্র পরিচয়ই তার জীবন এবং এই সত্ত্বার মধ্যে যে গভীরতা এবং ভাবের দিক রয়েছে, তা চিহ্নিত করে।

গল্পের শুরুতেই তারাপদের চরিত্রের পরিচয় দেওয়া হয় এক রোমান্টিক, অবাধ পথিক হিসেবে। আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী…”—এই চরণগুলি তার চিরকালীন পথচলার ইঙ্গিত দেয়। সে একজন গৃহবন্দী নয়, বরং তার অন্তরাত্মা মুক্তির তাগিদে সদা নতুন নতুন অভিজ্ঞতা লাভের জন্য পথে পথে ছুটে চলে। তারাপদকে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা যায় যে, তার অন্তরের অভিলাষের তাগিদই তাকে শিকলমুক্ত এবং ভ্রাম্যমাণ করে তোলে। এটাই তার চরিত্রের প্রকৃত পরিচয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোস্টমাস্টার গল্পের সঙ্গে তুলনা করলে, তারাপদ এবং পোস্টমাস্টারের মধ্যে একটা গভীর মিল খুঁজে পাওয়া যায়—দুজনেরই জীবন এক বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, বরং তারা নিছক বোধহয় প্রকৃতির নিখাদ আহ্বানে বা আত্মিক তাগিদে ভ্রমণরত।

তারাপদ যখন প্রকৃতির সৌন্দর্য অনুভব করে, তখন সে বিচ্ছিন্নতা, শূন্যতা, এবং অতৃপ্তির মধ্যে হারিয়ে যায়। তার এই চলমানতা শুধুমাত্র বাহ্যিক নয়, এটি তার অন্তর্গত এক গভীর আত্মীক সন্ধানের প্রতিফলন। সে যখন গাছের পল্লবে বৃষ্টি পড়া দেখে, আকাশের মেঘ ডাকতে থাকে, বা অরণ্যের বাতাসের সুরে মাতাল হয়, তখন তার চিত্ত যেন অস্থির হয়ে ওঠে—এটা তার প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসারই নিদর্শন। সে একা, মুক্ত, অনন্ত পথিক—তাকে আটকে রাখতে পারে না কোনও কিছুর বাঁধন।

তারাপদের এই অবাধ যাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তাঁর অদৃশ্য আত্মবিশ্বাস। যদিও তিনি পারিবারিক স্নেহ এবং সঙ্গ উপভোগ করেন, তিনি কখনোই তাদের কাছে স্থির থাকতে চান না। তাদের স্নেহে বা ভালোবাসায় তিনি কখনোই আটকে পড়েন না, বরং প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং নিজস্ব এক স্বতন্ত্র পরিচয়ে হারিয়ে যান। চারু যখন তারাপদকে ভালবাসার প্রস্তাব দেয়, তখন তা তার জন্য এক অস্থির সময় তৈরি করে। পরিবারের ভালোবাসা, প্রথাগত সম্পর্ক, এ সব কিছু তার পথচলা থামাতে পারেনি। তার সত্যিকার সুখ প্রকৃতির মধ্যে, আত্মার মধ্যে, নিঃসঙ্গ পথচলার মধ্যে নিহিত।

তারাপদ ‘অতিথি’ হিসেবে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে জীবন্তভাবে উপভোগ করেন, কিন্তু কখনোই সে এক স্থানে থেমে থাকে না। মতিলালবাবু এবং অন্নপূর্ণার স্নেহ তার জীবনে কিছু সময়ের জন্য উপস্থিত হলেও, তা তাকে ধরে রাখতে পারেনি। তার অন্তরে এক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ছিল—এক যে কোনও বন্ধনকে ভেঙে ছুটে চলার আকাঙ্ক্ষা। “হে ক্ষণিকের অতিথি, এলে তুমি কারে চাহিয়া ঝরা শেফালির পথ বাহিয়া”—এই কথা যেন তার জীবন এবং মননের প্রতিচ্ছবি। তারাপদের জীবনে কোনই স্থায়ীত্ব নেই, বরং সে স্রোতের মতো চলতে থাকে, কিছুতেই এক স্থানে থামে না।

এখানে তারাপদ যেন একটি মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠে ‘অতিথি’ বা পথে চলা এক চিরযাত্রী, যাকে প্রথাগত সম্পর্কের কোনো বাঁধন কিংবা পারিবারিক মায়া আটকে রাখতে পারে না। তারাপদের এই জীবনধারা একদিকে যেমন তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও ভাবুকতার প্রতীক, তেমনি এটি আমাদের সমাজের স্নেহ, বন্ধন ও সম্পর্কের পরিসীমা নিয়ে এক গভীর প্রশ্ন তোলে। তারাপদ তার প্রতিটি মুহূর্তে প্রকৃতির রূপ এবং মানব সম্পর্কের সৌন্দর্য অনুভব করে, কিন্তু সে কখনোই তার জীবনকে ঐশ্বর্য বা স্থায়ীত্বে আবদ্ধ করতে চায় না।

এভাবেই আশাপূর্ণা দেবী অতিথি গল্পের মাধ্যমে জীবনের পথে চলা এক অবাধ মুক্ত, চিন্তাশীল এবং অসীম যাত্রীর ছবি আঁকেন। তারাপদ এই গল্পে এক আদর্শ ‘অতিথি’, যার জীবন কেবলমাত্র তাঁর অন্তরের তাগিদে, তাঁর চিরকালীন যাত্রার মাধ্যমে নির্মিত হয়।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading