অতি সংক্ষেপে ভাওয়াইয়ার বৈশিষ্ট্য লেখো।

ভাওয়াইয়ার বৈশিষ্ট্য:

উঁচু-নিচু রাস্তায় গাড়ির চাকা পড়লে তার গানের সুরে আধো-ভাঙ্গা বা ভাঁজ পড়ে। এই রকম সুরে ভাঙ্গা বা ভাঁজ পড়া গীতরীতিই ‘ভাওয়াইয়া’ গানে লক্ষণীয়। প্রেম-বিয়োগে উদ্বেলিত গলার স্বর জড়িয়ে যেরকম হয়, সেরকম একটা সুরের ভাঁজ উঁচু স্বর হতে ক্রমশঃ নিচের দিকে নেমে আসে। সুরে ভাঁজ পড়া ভাওয়াইয়া গানের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য।

ভাওয়াইয়ার সুর ও ছন্দ:

ভাওয়াইয়ার সুরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো টানা সুর। এর মাঝে সুরের ভাঙ্গন রয়েছে। গবেষকদের মতে উঁচিনিচু বা অসমান পথে চলমান মহিষের গাড়িতে গাড়িয়াল যখন গান গাইতে থাকে, তখন চাকার উত্থান পতনে কণ্ঠস্বরে ভাঙানির প্রভাব পড়ে। এর সুরের মূল কাঠামো দাঁড়ায় স রে গ ম প ধ ণ। এরই নানারূপ আরোহ, অবরোহ ও বক্র রীতি অনুসারে সুরবিন্যাস হয়। ভাওয়াইয়া গানে কোমল ঋষভ, কড়ি মধ্যম ও শুদ্ধ নিষাদের ব্যবহার বিরল। তবে কোমল গান্ধার ও কোমল ধৈবতের অল্পবিস্তর ব্যবহৃত হয়।

সাধারণভাবে ভাওইয়ার সুরে ধাপে ধাপে আরোহ-অবরোহের চলন পাওয়া যায়। সাধারণ তার সপ্তকে গানের সুরে ‘ভাঙানি’। এবং ভাঙানির পরে নিচের স্বরে নেমে আসে। সুরের এরূপ প্রয়োগের কারণে ভাওয়াইয়া একটি বিশেষ সুরে ধারায় চেনা যায়।

ভাওয়াইয়ার তাল:

সাধারণভাবে সবেচেয়ে বেশি দেখা যায় কাহারবা ও দাদরা তাল। কিছু গান পাওয়া যায় তেওরাতে। তবে ভাওইয়ার দাদরা ঠিক ৩।৩ ছন্দের, কিন্তু ছন্দের দোলাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এই কারণে অনেকে একে ৬ মাত্রার সোওয়ারি বলে থাকেন। অনেকে একে মৈষালি চালও বলে থাকেন। কিছু ভাওয়াইয়া বৈতালিকে গাওয়া হয়।

সুরের চলনের বিচারে ভাওয়াইয়া গানকে প্রাথমিকভাবে ৩টি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ ৩টি হলো দরিয়া, চটকা ও বৈতালিক।

ভাওয়াইয়ার দরিয়া:

এই অঙ্গের ভাওইয়া মূলত প্রেম, বিরহ-বিচ্ছেদ। তাই এই গানে এক ধরনের হাহাকার থাকে। সুর ও বাণীর সমন্বয়ে এই গানে করুণ রসের সঞ্চার ঘটে। এই শ্রেণির গানকে আরও কিছু উপভাগে ভাগ করা হয়। যেমন-সতাল দরিয়া: এই দরিয়া অনেকটা কাব্যিক। নানা ধরনের উপমার ভিতর দিয়ে ব্যঞ্জনা তৈরি করে বাণীর চলন তৈরি হয়। তবে এতে বিরহ বা বিচ্ছেদের ভাবটা বেশি পাওয়া যায়।ক্ষিরোল দরিয়া: অপেক্ষাকৃত চটুল এবং প্রেমের গান। এই গানের বাণী ও সুরের সাথে দোতারা বিশেষ ধ্বনি ড্যাং ব্যবহার করা হয়। এই বিশেষ ধ্বনিকে অনেক সময় ক্ষিরোল ড্যাং বলা হয়।চিতান দরিয়া: এই গানে অন্তরা থেকে এই সুর মধ্যসপ্তকে থাকে। এরপর এই সুর উচ্চগ্রামে বিস্তার লাভ করে। এই সুর নিচের দিকে আর নামে না।সোয়ারি দরিয়া: মহিষের পিঠে চলমান দশায় যে ভাওইয়ার সুর বিশেষভাবে আন্দোলিত হয় এবং একই সাথে গলা-ভাঙানির সৃষ্টি হয়, তাকেই সোয়ারি দরিয়া বলে। এই গানকে অনেক সময় মৈষাল বন্ধুর গান বলা হয়।গরাল দরিয়া: এই গানের সুর মীড়-প্রধান। অর্থাৎ এই গানর সুর গড়িয়ে গড়িয়ে চলে।চেলোন্তী দরিয়া: দ্রুত লয়ের ভাওয়াইয়াকে এই নামে চিহ্নিত করা হয়।

চটকা ভাওয়াইয়া :

লঘু তাল ও ছন্দে এই গান পরিবেশিত হয়। এই গানে লঘু তালে এবং জলদ লয়ে পরিবেশিত হয়। ফলে দরিয়া গানের মতো এই গানে প্রলম্বিত সুরের বিন্যাসের ধীরস্থির ভাবটি পাওয়া যায় না। চটকা ভাওয়াইয়াতে বিশেষ ঢং-এর দোতরার বাদনশৈলী পাওয়া যায়। এই বিশেষ ঢং-কে চটকার নিজস্ব শৈলী হিসেবে বিবেচনা করা। এই বিশেষ বাদনশৈলী-নির্ভর চটকাকে অনেকে বিশুদ্ধ চটকা বলে থাকেন। এর বাইরে পরিবেশনের প্রকৃতি অনুসারে এই গানের কয়েকটি প্রকরণ পাওয়া যায়। যেমন-খ্যামটা অঙ্গের চটকা: এই অঙ্গের চটকা গানে নাগরিক গানের মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। অনেক সময় এই জাতীয় গানে ত্রিতালের মতো শাস্ত্রীয় তালের ব্যবহার করা হয়। এই গানে চটুল দুলুনী থাকে, যার সাথে খ্যামটা গানের ভাব পাওয়া যায়। যেমন-

বাপুই চ্যাঙেরারে গাচোত চড়িয়া

দুইটা জলপই পাড়িয়া দে।ঝুমুর চটকা: এই জাতীয় চটকায় ঝুমুর তাল বাজানো হয়। এই ঝুমুরটির প্রকৃতি অনেকাটা দ্রুত দাদরার মতো। তবে ঠিক ঝুমুর গানের মতো দোলাযুক্ত নয়। এই গানের বাণীও চটুল হয়ে থাকে।

বৈতালিক ভাওয়াইয়া:

এই জাতীয় ভাওয়াইয়া ছন্দে গাওয়া হয়। প্রথাগত আবর্তিত ছন্দের সূত্রে যে তালের বিন্যাস ঘটে, তার ব্যবহার এই গানে লক্ষ্য করা যায় না। তাই তালহীন অর্থে এই গানকে বৈতালিক বলা হয়।

রাজবংশীদের আদি সুরে বাঁশী ও ঢোল ব্যবহৃত হতো। বাংলা ভাওয়াইয়া গানে যুক্ত হয়েছে দোতরা। তবে এই দোতারায় ব্যবহৃত হয় ইস্পাতের তারের পরিবর্তে মুগা সুতা।

ভাওয়াইয়া শিল্পীগণ:

প্রধানত স্থানীয় রাজবংশী ও কামতাপুরী সম্প্রদায়ের মানুষজনই ভাওয়াইয়া শিল্পী হয়ে থাকেন। এছাড়াও, ব্রাহ্মণ, কোচ, যোগী, খেন ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষও এই শিল্পের সাথে যুক্ত।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading