অধ্যয়নের শৃঙ্খলা হিসাবে জনপ্রশাসনের বিবর্তন আলোচনা কর।  Discuss the evolution of Public Administration as a discipline of study.

অধ্যয়নের শৃঙ্খলা হিসাবে জনপ্রশাসনের বিবর্তন-

জনপ্রশাসন শব্দটি একটি গভীর অর্থপূর্ণ ধারণা, যা সরকারী কার্যক্রমের পরিচালনা এবং রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত। জনগণের সেবা, নীতির বাস্তবায়ন, আইনের শাসন, এবং সরকারি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত কার্যাবলির সমন্বয়ের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণে কাজ করা জনপ্রশাসন। তবে জনপ্রশাসনের অধ্যয়ন এক সময় শুধুমাত্র প্রশাসনিক কার্যাবলি এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল না, সময়ের সাথে সাথে এটি একটি পৃথক শৃঙ্খলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তার মৌলিক নীতিগুলি এবং পদ্ধতিগুলি বিশেষভাবে বিকশিত হয়েছে। জনপ্রশাসনের শৃঙ্খলার এই বিবর্তন বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত এবং প্রতিটি পর্যায়ে এর উদ্দেশ্য, পদ্ধতি, এবং কার্যক্রমের পরিবর্তন এবং প্রসার ঘটেছে।

১. প্রাথমিক পর্যায়: প্রাচীন কাল ও মধ্যযুগ

প্রাচীন এবং মধ্যযুগের প্রশাসনিক কাঠামোতে জনপ্রশাসন খুবই মৌলিক ও অসংগঠিত ছিল। বিশেষত প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে, যেমন মিশর, মেসোপটেমিয়া, চীন এবং ভারত, রাজা বা শাসকরা জনগণের শৃঙ্খলা রক্ষা এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিভিন্ন প্রথা এবং প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন। তবে এই সময়ে জনপ্রশাসনের কোনো সুনির্দিষ্ট শৃঙ্খলা ছিল না; মূলত শাসকদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা এবং রাজকীয় আদেশই প্রধান চালিকা শক্তি ছিল।

মধ্যযুগের পরে, বিশেষত ইউরোপে, রাজতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং রাজকীয় প্রশাসনের কার্যক্রম একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো এবং ব্যবস্থার অধীনে আসতে শুরু করে। এই সময়ে প্রশাসনিক কাজগুলো পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন কৌশল এবং মন্ত্রীসভার সদস্যদের ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হয়।

২. আধুনিক যুগের সূচনা: ১৭শ থেকে ১৮শ শতক

আধুনিক জনপ্রশাসন শৃঙ্খলার প্রথম উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে ১৭শ এবং ১৮শ শতকে, যখন ইউরোপে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়। এটি এমন একটি সময় ছিল যখন সমাজের কাঠামো এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমে আধুনিকীকরণের প্রবণতা শুরু হয়। ফরাসি বিপ্লব এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রামের পর, শাসন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের অংশগ্রহণ এবং প্রশাসনিক কার্যকলাপের ওপর সামাজিক ও আইনি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।

ম্যাক্স ওয়েবার এর জনপ্রশাসনের তত্ত্ব ১৮ শতকের শেষের দিকে একটি বড় ধরনের বিবর্তন আনতে সহায়ক হয়। ওয়েবার প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিষয়ে আধুনিক চিন্তাধারা এবং কার্যকরী প্রশাসনের জন্য তার “ব্যুরোক্রেসি” মডেল প্রবর্তন করেন। তিনি প্রশাসনকে একটি বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা করেন, যেখানে প্রতিটি পদ এবং দায়িত্ব স্পষ্টভাবে নির্ধারিত এবং কার্যক্রমে নিয়মাবলী এবং শৃঙ্খলা পালন করা হয়। তাঁর মতে, প্রশাসনিক পদগুলি দক্ষতার ভিত্তিতে হওয়া উচিত, যেখানে পেশাদারিত্ব এবং আধিকারিক কর্তৃত্বের মাধ্যমে কার্যকরভাবে সরকারী কাজ পরিচালিত হতে পারে।

৩. উনিশশত শতক: জনপ্রশাসনকে একটি পৃথক শৃঙ্খলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা

উনিশ শতকে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে, জনপ্রশাসন একটি স্বতন্ত্র শৃঙ্খলা হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করে। উড্রো উইলসন এর ১৮৮৭ সালে প্রবন্ধ “The Study of Administration” প্রকাশের মাধ্যমে জনপ্রশাসনের একটি একক শৃঙ্খলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ তৈরি হয়। উইলসন প্রশাসনিক কাজের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এবং সরকারের কর্মকাণ্ডে দক্ষতা আনার উপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তিনি সরকারী কর্মচারীদের রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে এবং পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার ওপর গুরুত্ব দেন।

এই সময়ে জনপ্রশাসনের অধ্যয়ন ছিল কার্যকরী শাসন ব্যবস্থা, দক্ষতার উপায়, এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন। জনপ্রশাসনকে একটি বিচ্ছিন্ন শৃঙ্খলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রক্রিয়া এই সময়ে উল্লেখযোগ্য।

৪. ২০শ শতক: জনপ্রশাসনে আধুনিক ধারণা এবং শিক্ষার প্রসার

২০শ শতকের শুরুতে, জনপ্রশাসনের উপর আরও গভীর গবেষণা এবং অধ্যয়ন শুরু হয়। হার্লো ওউইলিয়ামস, লুডভিগ লেইন এবং ডেভিড লওরেন্স প্রমুখ প্রশাসনিক তাত্ত্বিকরা প্রশাসনিক কাজের বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ ও শিক্ষার মাধ্যমে জনপ্রশাসনকে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। এর ফলে জনপ্রশাসন বিষয়টি একদিকে প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় নৈতিক দৃষ্টিকোণ প্রবর্তন করে।

বহু তাত্ত্বিক নতুন ধারণা যেমন প্রশাসনকে শুধু সরকারি কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজের প্রতিটি স্তরে তার প্রভাব বিস্তার করার প্রচেষ্টা করেন। অ্যাকটিভিজম এবং ব্যুরোক্রেসির চ্যালেঞ্জ এর মাধ্যমে জনপ্রশাসন বিদ্যমান সিস্টেমের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধের কৌশল সমর্থন করে।

৫. বর্তমান সময়: জনপ্রশাসনের বিকাশ

বর্তমানে, জনপ্রশাসন শৃঙ্খলা আরও বিস্তৃত এবং আধুনিক প্রযুক্তি, জনসাধারণের অংশগ্রহণ, এবং সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার উপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ই-গভর্নেন্স এবং ডিজিটাল প্রশাসন যেমন বিষয়গুলি জনপ্রশাসনের আধুনিক চেহারায় পরিণত হয়েছে। ২০শ শতকের শেষের দিকে প্রশাসন কেবল সরকারের বাইরেও কর্মক্ষমতা, সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রতিক্রিয়া, এবং জনগণের সুসংহত সেবা নিয়ে কাজ করছে।

বর্তমানে, জনপ্রশাসনের লক্ষ্য শুধু ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা নয়, বরং সেবামূলক প্রশাসন তৈরি করা যেখানে প্রশাসনিক কার্যকলাপ জনকল্যাণের দিকে পরিচালিত হয়। আধুনিক গবেষণায় জনপ্রশাসন একদিকে সরকারি নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, অন্যদিকে সামাজিক ন্যায়, মানবাধিকার এবং প্রশাসনিক সংস্কারের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করছে।

উপসংহার

জনপ্রশাসনের অধ্যয়নের বিবর্তন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যা বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জনপ্রশাসন এখন একটি বিচ্ছিন্ন শৃঙ্খলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যেখানে প্রশাসনের দক্ষতা, নৈতিকতা, এবং সমাজের কল্যাণমূলক উদ্দেশ্যগুলি মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। সরকারি কাজের প্রক্রিয়া, প্রশাসনিক পদ্ধতি এবং জনসেবা বর্তমান বিশ্বের অঙ্গীকার, যা জনগণের প্রতি সরকারের দায়িত্ব পালন করে থাকে।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading