অশোকের ধম্মের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখ
ভূমিকা
সম্রাট অশোক (খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮-২৩২) ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাসক হিসেবে পরিচিত। তার শাসনামল মগধের মউর্য সাম্রাজ্যের সোনালী যুগ হিসেবে বিবেচিত হয়। কৌটিল্য (চাণক্য) এবং তাঁর নীতি অনুসরণ করে অশোক প্রথম দিকে সাম্রাজ্য বিস্তারে আগ্রহী ছিলেন। তবে, কলিঙ্গ যুদ্ধের পর তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন আসে এবং তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের পর অশোক তাঁর রাজ্যে ‘ধম্ম’ বা ধর্ম প্রচার করতে শুরু করেন, যা মূলত বৌদ্ধ ধর্মের মূলনীতির উপর ভিত্তি করে গঠিত ছিল। অশোকের ধম্মের বৈশিষ্ট্যগুলি তাকে শুধু একটি মহান সম্রাট হিসেবেই নয়, বরং একজন মানবতাবাদী শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
অশোকের ধম্মের মূল বৈশিষ্ট্য
১. অহিংসা ও সহানুভূতি
অশোকের ধম্মের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল অহিংসা (অহিংসা) ও সহানুভূতি (মৈত্রী)। কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক যুদ্ধের বর্বরতা ও হিংসার প্রভাব সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তিনি অহিংসার নীতি প্রচার করতে শুরু করেন। তিনি শুধু মানুষের প্রতি নয়, সকল জীবের প্রতি সহানুভূতি ও করুণার শিক্ষা দিয়েছিলেন।
২. সকল জীবের প্রতি সমান আচরণ
অশোক সকল জীবের প্রতি সমান আচরণের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি প্রাণীদের হত্যা ও বলিদান নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং বিভিন্ন প্রকার প্রাণী সংরক্ষণ আইন চালু করেছিলেন। তাঁর রাজ্যে বিভিন্ন স্থানে পশু হাসপাতাল ও অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
৩. ধর্মীয় সহনশীলতা
অশোকের ধম্মের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মীয় সহনশীলতা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সকল ধর্মের মূল উদ্দেশ্য একই, অর্থাৎ মানুষের কল্যাণ। তাই তিনি সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন এবং তাঁর রাজ্যে ধর্মীয় সহনশীলতা প্রচলিত করেছিলেন। অশোক নিজে বৌদ্ধ ধর্ম অনুসরণ করলেও তিনি হিন্দু, জৈন, এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেন।
৪. সামাজিক ন্যায়বিচার
অশোকের ধম্ম সামাজিক ন্যায়বিচারের উপর গুরুত্ব দিয়েছিল। তিনি সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের প্রতি সমান দৃষ্টি রেখেছিলেন এবং বিশেষত দরিদ্র ও দুর্বলদের কল্যাণে কাজ করেছিলেন। তিনি ধম্মমহামাত্র নামে বিশেষ আধিকারিক নিয়োগ করেছিলেন, যারা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে মানুষের সমস্যা শুনতেন এবং তাদের সমাধান করতেন।
৫. পরোপকার ও দানশীলতা
অশোকের ধম্মে পরোপকার ও দানশীলতার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। তিনি মানুষের সেবা ও কল্যাণমূলক কাজকর্মে বিশ্বাস করতেন। তাঁর শাসনামলে বিভিন্ন স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্প, যেমন রাস্তা নির্মাণ, পানীয় জলের ব্যবস্থা, এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছিল।
৬. সৎচরিত্র ও নৈতিকতা
অশোকের ধম্মে সৎচরিত্র ও নৈতিকতার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে একজন মানুষের প্রকৃত শক্তি তার চরিত্র ও নৈতিকতার উপর নির্ভর করে। তাই তিনি তার প্রজাদের সৎচরিত্র ও নৈতিকতা রক্ষার শিক্ষা দিতেন।
৭. সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ
অশোক সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে বিশ্বাস করতেন। তিনি জনগণের মতামত ও অভাব-অভিযোগ শুনতে পছন্দ করতেন এবং তাদের প্রয়োজন ও কল্যাণে কাজ করতেন। তিনি বিভিন্ন স্থানে রক এডিক্ট (শিলালিপি) স্থাপন করেছিলেন, যাতে সাধারণ মানুষ সহজেই তাঁর নির্দেশনা ও ধম্মের মর্মার্থ সম্পর্কে জানতে পারে।
৮. আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব
অশোকের ধম্মে আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসবের মাধ্যমে ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের উন্নয়ন ঘটানো হয়েছিল। তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব ও আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন, যাতে মানুষ একত্রিত হয়ে ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারে।
অশোকের ধম্মের প্রসার
১. রক এডিক্ট ও স্তম্ভ
অশোক তার ধম্মের প্রচারের জন্য রক এডিক্ট (শিলালিপি) ও স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন। এই শিলালিপিগুলি বিভিন্ন ভাষায় লিখিত ছিল এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা হয়েছিল। এই শিলালিপিগুলির মাধ্যমে অশোক তার ধম্মের মূলনীতিগুলি জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
২. ধম্মমহামাত্র নিয়োগ
অশোক ধম্মমহামাত্র নামে বিশেষ আধিকারিক নিয়োগ করেছিলেন, যারা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে ধম্ম প্রচার করতেন এবং মানুষের সমস্যার সমাধান করতেন। তারা সমাজের দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণীর মানুষের কল্যাণে কাজ করতেন।
৩. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
অশোক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মাধ্যমে তার ধম্মের প্রসার ঘটিয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন দেশের রাজাদের সাথে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন এবং তাদের কাছে বৌদ্ধ ধর্মের মূলনীতিগুলি প্রচার করেছিলেন। এই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্ম চীন, জাপান, শ্রীলঙ্কা, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রসার লাভ করেছিল।
অশোকের ধম্মের প্রভাব
১. ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি
অশোকের ধম্ম ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তার শাসনামলে ধর্মীয় সহনশীলতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে নৈতিকতার গুরুত্ব প্রচার করেছিলেন, যা ভারতীয় সমাজে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল।
২. বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার
অশোকের ধম্ম বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তার শাসনামলে বৌদ্ধ ধর্ম ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে চীন, জাপান, কোরিয়া, তিব্বত, শ্রীলঙ্কা, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রসার লাভ করেছিল।
৩. আধুনিক যুগে অশোকের প্রাসঙ্গিকতা
অশোকের ধম্ম আজকের যুগেও প্রাসঙ্গিক। তার অহিংসা, সহানুভূতি, ধর্মীয় সহনশীলতা, সামাজিক ন্যায়বিচার, এবং নৈতিকতার শিক্ষা আজকের সমাজেও প্রয়োজনীয়। আধুনিক সমাজে ধর্মীয় সহনশীলতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অশোকের ধম্ম একটি মূল্যবান দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
উপসংহার
অশোকের ধম্ম প্রাচীন ভারতীয় সমাজে একটি নতুন ধর্মীয় ও সামাজিক ধারার সূচনা করেছিল। তার অহিংসা, সহানুভূতি, ধর্মীয় সহনশীলতা, সামাজিক ন্যায়বিচার, এবং নৈতিকতার শিক্ষা ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। অশোকের ধম্মের মূলনীতিগুলি আজও প্রাসঙ্গিক এবং আধুনিক সমাজে ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অশোক একজন মহান সম্রাট ও মানবতাবাদী শাসক হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন, যার ধম্মের শিক্ষা আমাদের সকলের জন্য একটি মূল্যবান দৃষ্টান্ত।