আদি-মধ্যযুগের ভারতে স্থাপত্য:
আদি-মধ্যযুগের ভারতে স্থাপত্যশিল্পের কেন্দ্রে ছিল মন্দির। গুপ্তযুগে মন্দির স্থাপত্যের সূচনা হলেও, বৈচিত্র্য ও অলংকরণের দিক থেকে আদি-মধ্যযুগেই মন্দির শিল্প আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। ভারতীয় মন্দির শিল্পে তিনটি ধারার উপস্থিতি দেখা যায়—নাগর রীতি, দ্রাবিড় রীতি ও বেসরা রীতি। নাগরশৈলীর মন্দিরগুলি সাধারণভাবে হয় বর্গাকৃতি। দ্রাবিড়শৈলী অষ্টকোণবিশিষ্ট এবং বেসরাশৈলীর বৈশিষ্ট্য বৃত্তাকার গৃহ। অবশ্য এই শৈলী কঠোরভাবে কোনো বিশেষ এলাকায় অনুসৃত হত, এমন নয়। সাধারণভাবে হিমালয় ও বিন্ধ্য পর্বতের মধ্যবর্তী অঞ্চলে নাগর রীতির জনপ্রিয়তা ছিল। দ্রাবিড় রীতির প্রকাশ ও প্রয়োগ দেখা যায় সুদূর দক্ষিণে কৃষ্ণানদী থেকে কন্যাকুমারিকার মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে। বিন্ধ্য থেকে কৃষ্ণা নদীর অন্তর্বর্তী ভূভাগে প্রচলিত ছিল বেসরা রীতি। তবে বেসরা রীতির মধ্যে মৌলিকত্বের অভাব আছে। আসলে এই শৈলী নাগর ও দ্রাবিড় শৈলীর সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছে। শুধুমাত্র হোয়সল রাজাদের স্থাপত্যকর্মে এই রীতির প্রয়োগ দেখা যায়। সে কারণে এটিকে ‘চালুক্যশৈলী ও বলা হয়। সাধারণভাবে উত্তর ও পূর্ব ভারতে নাগর রীতির ব্যাপক প্রয়োগ দেখা যায়। একইভাবে দক্ষিণ ভারত ও দাক্ষিণাত্যে দ্রাবিড় রীতিতেই প্রায় সকল স্থাপত্য সৃষ্টি গড়ে উঠেছে।
(ক) স্তূপ : আদি-মধ্যযুগে বাংলার শিল্পচর্চার মধ্যে স্থাপত্য, ভাস্কর্য, স্তূপ, বিহার, মন্দির ইত্যাদি সবই ছিল। ‘রামচরিত’ গ্রন্থের লেখক সন্ধ্যাকর নন্দী একাদশ শতকের বাংলায় ‘প্রাংশু প্রাসাদ’, ‘মহাবিহার, কাঞ্চনখচিত প্রাসাদ ও মন্দির ছিল বলে গর্ববোধ করেছেন। কিন্তু তাদের সবই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ড. মজুমদারের ভাষায়, ‘বাংলার স্থাপত্যশিল্পের কীর্তি আছে, কিন্তু নিদর্শন নাই।” চিনদেশীয় পর্যটকরা বাংলাদেশে অসংখ্য স্তূপের কথা বলেছেন। কিন্তু পাথরের অভাবহেতু ইটে নির্মিত এই সকল স্তূপের অধিকাংশই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বৌদ্ধধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট স্থাপত্য-কীর্তিগুলির মধ্যে অন্যতম হল স্তূপ। মহাপরিনির্বাণ সুওস্ত অনুসারে মৃত্যুশয্যায় শায়িত বুদ্ধকে তাঁর শিষ্যরা প্রশ্ন করেছিলেন যে, মৃত্যুর পর তাঁর সমাধি কী পরিকল্পনায় নির্মিত হবে? বুদ্ধ তাঁর রুগ্ন হস্ত শূন্যে সঞ্চালন করে একটি অর্ধবৃত্তাকার রেখা অঙ্কন করেন। এ থেকে শিষ্যদের ধারণা হয় যে, তিনি স্তূপ নির্মাণের ইঙ্গিত করছেন। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, স্তূপ নির্মাণের পদ্ধতি বুদ্ধের পূর্বে, সম্ভবত বৈদিক যুগ থেকেই জ্ঞাত ছিল। বৈদিকরীতি অনুসারে মৃতদেহের ভস্মাবশেষ শ্মশানে প্রোথিত করা হত। সম্ভবত এ থেকেই বৌদ্ধ ও জৈনগণ স্তূপের ধারণা লাভ করেন। তবে পরবর্তীকালে বৌদ্ধদের সাথে স্তূপের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অনেকে মনে করেন, স্তূপ হল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্র সংস্করণ। বৌদ্ধগণ প্রথমদিকে তাদের উপাসনাস্থলে স্তূপ নির্মাণ করত, ক্রমশ স্তূপ নির্মাণও পুণ্যকর্ম বলে বিবেচিত হতে থাকে এবং বুদ্ধের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট স্থানগুলিতে ভক্তগণ স্তূপ নির্মাণ করতে থাকেন।
প্রথমে স্তূপের গঠনপ্রণালী ছিল জটিলতাবর্জিত। স্তূপের জন্য নির্দিষ্ট ভূমিতে প্রথমে একটি ‘বেদি’ বা ‘বেদিকা’ প্রস্তুত করা হত। এর ওপর গঠিত ক্ষুদ্র বেদিকে বলা হত ‘মেধী’। ‘অণ্ড ‘নামে পরিচিত স্তূপের অর্ধগোলাকার, গম্বুজাকার অংশ এই মেধীর ওপর রক্ষিত হত। অণ্ডই ছিল স্তূপের মূল উপাদান। অঙের উপরিভাগ সামান্য সমতল হত। এখানে একটি চতুষ্কোণ রেলিং-বেষ্টিত স্থান থাকত। এর মাঝখান থেকে উত্থিত হত একটি কান্ঠ অথবা প্রস্তর নির্মিত দণ্ড। এই দণ্ডকে বলা হত ‘ছত্রদণ্ড’। এর সাথে যুক্ত থাকত ছত্রাবলী। স্তূপকে বেষ্টন করে কাঠের বা পাথরের বেষ্টনী থাকত। এই বেষ্টনীর ভিতর একটি আবদ্ধ পথের সৃষ্টি হত, যাকে বলা হত ‘প্রদক্ষিণ পথ’। এই পথে স্তূপ প্রদক্ষিণ করে মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করত। এখানে পৌঁছাবার জন্য স্তূপের চারদিকে চারটি তোরণদ্বার থাকত। কিছু স্তূপে বুদ্ধদেব বা তাঁর প্রধান শিষ্যদের দেহাবশেষ রক্ষিত হত। কিছু স্তূপ বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানে স্থাপিত হত। এই স্তূপগুলিকে ‘স্মারকস্তূপ’ বলা যায়। এ ছাড়া ধার্মিক বৌদ্ধগণ বুদ্ধের প্রতীক হিসেবে আরাধনা করার জন্যও কিছু স্বপ নির্মাণ করতেন। দক্ষিণ ভারতীয় স্তূপগুলির নির্মাণশৈলী ছিল কিছু আলাদা। প্রথমদিকে সমগ্র স্তূপটি নিশ্ছিদ্র ইটের গাঁথনি দিয়ে তৈরি হত। পরে স্তূপের কেন্দ্রে ও বাইরে দুটি গোলাকার প্রাচীর নির্মাণ করে, সে দুটিকে যুক্ত করে, মধ্যবর্তী অংশ মাটি দিয়ে পূর্ণ করা হত। সম্ভবত ইটের ব্যবহার কমানোর জন্যই গঠনরীতিতে এ ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছিল।
(খ) বিহার : স্তূপের মতোই ‘বিহার’গুলির ধ্বংসাবশেষ মাত্র পাওয়া যায়। ভিক্ষুদের বাসস্থান হিসেবেই বিহারগুলির পরিকল্পনা ও নির্মাণ করা হত। পরে এগুলি বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে পরিণত হয়। রাজশাহির অন্তর্গত পাহাড়পুরে একটি বিশালাকার বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। সম্ভবত, পালরাজা ধর্মপাল অষ্টম শতকে এটি নির্মাণ করেছিলেন। ‘সোমপুর মহাবিহার’ নামে এটি বিশ্বখ্যাত হয়ে আছে। বিশালাকার এই বিহারের চতুষ্কোণ অঙ্গনটি প্রতিদিকে ৩০০ গজ দীর্ঘ ছিল। একটি উচ্চ প্রাচীর দ্বারা অঙ্গনটি পরিবেষ্টিত। প্রাচীরের চারদিকে ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য প্রায় ১৮০টি (মতান্তরে ১৭৭টি) ছোটো ছোটো কক্ষ নির্মিত ছিল। মধ্যস্থলে প্রশস্ত অঙ্গন এবং সেখানে নির্মিত ছিল একটি মন্দির। পোড়ামাটির ইটের তৈরি মন্দিরটি ‘সর্বতোভদ্র’ শিল্পরীতিতে নির্মিত হয়েছিল। এমন মন্দিরের নিদর্শন যবদ্বীপ ও ব্রহ্মদেশেও দেখা যায়। সমকালীন একটি লেখতে এই বিহারকে ‘জগতে নয়নের একমাত্র বিশ্রামস্থল’ (জগতাৎ নেত্ৰৈক বিশ্রাম ভূ’) অর্থাৎ নয়ন মনোহর কীর্তি বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কুমিল্লার নিকট ‘ময়নামতী’তে কয়েকটি বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে।
(গ) মন্দির : ‘রামচরিত’গ্রন্থে রামাবতীকে ‘ঈশ্বরের অধিষ্ঠান ক্ষেত্র’ বলা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল সেই সকল মন্দিরের অধিকাংশই কেবল ধ্বংসস্তূপের মধ্যে জেগে আছে। আদি-মধ্যযুগের মন্দির শিল্পের নিদর্শন হিসেবে সোমপুর বিহারের মধ্যবর্তী অঙ্গনের মন্দিরটিই নজরে পড়ে। মন্দিরের চাল নেই, চূড়া নেই, চারিদিকের প্রাচীর ভেঙে পড়েছে, প্রদক্ষিণ পথ ঢাকা পড়েছে ইটে, তবুও এই বিরাট ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে এর গঠনরেখা ও রীতি ধীরে ধীরে অনুসরণ করলে এর আকৃতি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিশেষত কাশীনাথ দীক্ষিত ও সরসীকুমার সরস্বতীর প্রচেষ্টায় মন্দিরটির মৌলিক রূপ ও গঠন অনেকটাই বোধগম্য হয়ে উঠেছে। ভারতীয় বাস্তুশাস্ত্রে সর্বতোভদ্র বলে একপ্রকার মন্দিরের উল্লেখ আছে। এ ধরনের মন্দিরের গঠনরীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এগুলি হবে চতুঃষ্কোণ এবং চতুঃশাল-গৃহ অর্থাৎ চারটি গর্ভগৃহবিশিষ্ট। মন্দিরগুলি পঞ্চতল। চতুষ্কোপের এক একটি বাহু সামনের দিকে বাড়িয়ে প্রতি বাহুর সাহায্যে চারটি করে কোণ তৈরি করা হত। এইভাবে চারদিকে ১৬টি কোণ রচিত হত। প্রতিটি তলকে বেষ্টন করে থাকত প্রদক্ষিণ পথ যেটি প্রাচীর বেষ্টিত হত। সমগ্র মন্দিরটি অলংকৃত হত বহু শিখর ও চুড়ার দ্বারা। অধ্যাপক সরস্বতী মনে করেন, পাহাড়পুরের মন্দিরটি এই সর্বতোভদ্র মন্দিরের রীতিতেই নির্মিত হয়েছিল। কারণ এই মন্দিরটিও গড়ে উঠেছিল একটি বিরাটাকায় চতুষ্কোণ স্তম্ভকে কেন্দ্র করে। একে ঘিরেই গঠিত হয়েছিল প্রতিটি তল, প্রদক্ষিণ পথ ও প্রাচীর। দ্বিতীয় তলে ছিল স্তম্ভের চারদিকে চারটি গর্ভগৃহ। সম্ভবত এটিই ছিল প্রধান তল। স্তম্ভের ওপরে মন্দিরের শীর্ষটি রক্ষিত ছিল। তবে এই অংশটি ভগ্ন, তাই শীর্ষের আকৃতি কীরূপ (শিখরাকৃতি বা স্তূপাকৃতি) তা বোঝা যায় না। পাহাড়পুরের মন্দিরটি ছিল সম্ভবত জৈন মন্দির। ভারতে এ ধরনের মন্দির বিশেষ দেখা না গেলেও ব্রহ্মদেশ, যবদ্বীপ ও কম্বোডিয়ায় এ ধরনের মন্দিরের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। পাহাড়পুরের মন্দির ছাড়াও এ যুগে নির্মিত অন্যান্য মন্দিরগুলি হল পুরুলিয়ার চীরার ‘জৈন মন্দির’, বাঁকুড়ার বহলারা গ্রামের ‘সিদ্ধেশ্বর মন্দির’ ইত্যাদি। দিনাজপুর রাজবাড়িতে কারুকার্য খচিত একটি প্রস্তরস্তম্ভ রক্ষিত আছে। এর গাত্রে উৎকীর্ণ লিপি থেকে অনুমান করা হয় যে, গৌড়রাজ প্রতিষ্ঠিত একটি শিবমন্দিরের অংশ। ড. মজুমদারের মতে, এই মন্দিরটি নবম শতকে নির্মিত হয়েছিল। এ ছাড়া, হাণ্ডিয়াল (পাবনা), পাইকোর (বীরভূম), বানগড় প্রভৃতি স্থানে যেসব প্রস্তরখণ্ড পাওয়া গেছে, সেগুলিকে মন্দিরের অবশিষ্ট বলে অনুমান করা হয়।
পল্লবযুগে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র মন্দির স্থাপত্যের যে রীতি চালু হয়েছিল, চোলদের আমলে তা পূর্ণতা পায়। পল্লব-স্থাপত্যের দ্রাবিড় শিল্পরীতি চোলদের আরও পরিশীলিত হয়ে ওঠে। দ্রাবিড় রীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল প্রধান গর্ভগৃহের ওপর পর পর তল নির্মাণ। পাঁচ থেকে সাতটি তল থাকত, একে বলা হত ‘বিমান’। গর্ভগৃহের সম্মুখভাগে থাকত থামবিশিষ্ট হল ঘর, একে বলা হত ‘মণ্ডপ’। এই মণ্ডপে সমবেত হয়ে ভক্তমণ্ডলী নৃত্যগীত পরিবেশন করতেন বা দেবতার পূজানুষ্ঠান উপভোগ করতেন। গর্ভগৃহের চারপাশে সরু পথ গর্ভগৃহকে বেষ্টন করে থাকত। এই পথে ভক্তরা মন্দির প্রদক্ষিণ করতেন। সমগ্র এলাকাটি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা থাকত। এই দেওয়ালের একাংশে থাকত সুউচ্চ তোরণ। এই তোরণকে বলা হত ‘গোপুরম’। অধ্যাপক সতীশচন্দ্রের মতে, কালক্রমে বিমান উচ্চ থেকে উচ্চতর হয়, মন্দির প্রাঙ্গন একাধিক হয় এবং গোপুরম সুবিন্যস্ত হয়। এইভাবে মন্দির ছোটো ছোটো নগর বা রাজপ্রাসাদে পরিণত হয়। এই মন্দিরের মধ্যেই থাকত পুরোহিতদের বাসগৃহ, অতিথি নিবাস ও অন্যান্য নানা জিনিস।
চোলদের প্রথম যুগের অন্যতম উল্লেখযোগ্য মন্দির শিল্প হল নর্ত্তমলই-এ স্থাপিত ‘বিজয়ালয় চোলেশ্বর মন্দির’। পল্লব শিল্পরীতির প্রভাবমুক্ত চোলস্থাপত্যের প্রকাশ দেখা যায় রাজা প্রথম পরস্তকের রাজত্বকালে। এই সময় ত্রিচিনোপল্লী জেলার সন্নিকটে শ্রীনিবাস নন্নুর নামক স্থানে ‘কোরঙ্গনাথ মন্দির’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নির্মাণশৈলীতে পল্লব-স্থাপত্যের সামান্য প্রভাব থাকলেও এটিকে দ্রাবিড় মন্দির স্থাপত্যরীতির এক স্বতন্ত্র ধারার প্রাথমিক প্রকাশ হিসেবে গণ্য করা যায়। স্বতন্ত্র দ্রাবিড় রীতির সুবিন্যস্ত ও সুপরিকল্পিত নিদর্শনগুলির অন্যতম হল প্রথম রাজরাজ নির্মিত তাঞ্জোরের ‘বৃহদীশ্বর মন্দির’। এটিকে ‘রাজরাজেশ্বর মন্দির’ও বলা হয়। কারণ চোলরাজারা মন্দিরে দেবমূর্তি বাদে রাজা ও রানির মূর্তিও স্থাপন করতেন।
মন্দিরটি নির্মাণ করেন। একই পরিকল্পনায় এটি নির্মিত হলেও আকৃতি ও অলংকরণের দিক থেকে এই মন্দির বৃহদেশ্বরী মন্দিরকে ছাপিয়ে যেতে পারে। ১০০ ফুট চওড়া ভিত্তি ও ১৮৬ ফুট উচ্চতার এই মন্দিরের সাথে যুক্ত বিমানটি ও মণ্ডপ একটি গলিপথ দ্বারা যুক্ত। পিতা ও পুত্রের অবিস্মরণীয় স্থাপত্যকর্মের নিদর্শন এই দুটি মন্দিরের সৌন্দর্যের বিচার করে কোনো কোনো শিল্পরসিক প্রথমটির মধ্যে ‘পুরুষোচিত গাম্ভীর্য এবং দ্বিতীয়টির মধ্যে ‘নারীসুলভ কমনীয়তা’ লক্ষ্য করেছেন। একটি শক্তির প্রতীক, অন্যটি সৌন্দর্যের।
চোল স্থাপত্যশৈলী পরবর্তী শতকেও নিজেকে বিকশিত করে চলে এবং রাজ্যের নানা অংশে ছোটো ছোটো স্থাপত্যকর্মের মধ্যে দিয়ে তা প্রকাশ পায়। এগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে দুটি মন্দির। এগুলি হল তাঞ্জোর জেলায় দারাসুরম মন্দির-এর ‘ঐরাবতেশ্বর’ মন্দির এবং কুম্ভকোনমের সন্নিকটে ‘ত্রিভুবনেশ্বর কম্পহরেশ্বর মন্দির। প্রথমটি নির্মিত হয় দ্বিতীয় রাজরাজের আমলে এবং দ্বিতীয়টির নির্মাতা তৃতীয় কুলোতুঙ্গ।
পরবর্তী-চালুক্য ও হোয়সল বংশের কালেও মন্দির নির্মাণ কাজ অব্যাহত ছিল। কল্যাণীর চালুক্যদের উদ্যোগে পশ্চিম দাক্ষিণাত্যের মন্দির স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় মহীশূরের হোয়সল মন্দিরগুলিতে। এই মন্দিরগুলির প্রধান তোরণ মন্দিরের সম্মুখভাগে না-রেখে পাশে রাখা হত। যে দেওয়ালের বাইরের দিকটি সু-অলংকৃত হত এবং বিমানগুলির নির্মাণশৈলীতে আদি চালুক্যদের সাধারণ ধাপবিশিষ্ট তলসমূহের সাথে হোয়সলদের ঘন সন্নিবিষ্ট তল পদ্ধতির সমন্বয় দেখা যায়। দশম শতকে নির্মিত কুক্কাসুরের ‘নবলিঙ্গ’ ও ‘কল্লেশ্বর’ মন্দিরে এই স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন দেখা যায়। একই ধরনের অন্যান্য নিদর্শনগুলি হল লাকুণ্ডির ‘কাশী-বিশ্বেশ্বর’, ইট্রাগির ‘মহাদেব’, কুরুভট্টির ‘মল্লিকার্জুন’ মন্দির ইত্যাদি।
নবম ও ত্রয়োদশ শতকের অন্তর্বর্তীকালে উত্তর ভারতের নাগর রীতিতে কলিঙ্গ রাজ্য বা উড়িষ্যাতে বহু মন্দির নির্মিত হয়। মন্দিরময় উড়িষ্যার কেন্দ্রে আছে ভুবনেশ্বর, যেখানে প্রায় ত্রিশটি মন্দির আছে। এর পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে অবস্থিত আছে দুটি বৃহৎ ও কারুকার্যময় স্থাপত্যকলার নিদর্শন— পুরীর ‘জগন্নাথ মন্দির’ এবং কোনারকের ‘সূর্য মন্দির’। গঞ্জাম জেলায় সমুদ্র উপকূল অঞ্চলে মুখলিঙ্গম শিল্পধারায় অনেকগুলি মন্দির নবম শতকে নির্মিত হয়। এদের স্থাপত্যরীতির ওপর চালুক্য মন্দির-রীতির বিশেষ প্রভাব দেখা যায়। ‘মুখলিঙ্গেশ্বর মন্দিরের প্রধান দেবতাকে ঘিরে চতুর্দিকে অন্য চারজন কম গুরুত্বপূর্ণ দেবমূর্তির অধিষ্ঠান দেখা যায়। এই মন্দিরের অলংকরণে চালুক্য ও গুপ্ত অলংকরণ-শৈলীর সমন্বয় দেখা যায়।
উড়িষ্যার মন্দির স্থাপত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল চতুষ্কোণ দেবালয়। মূল মন্দির ‘দেউল’ নামে অভিহিত হয়। দেউলের সম্মুখভাগে থাকে প্রশস্ত প্রার্থনা কক্ষ। এর নাম ‘জগমোহন’। বড়ো বড়ো মন্দিরে জগমোহনের সম্মুখভাগে আরও দুটি বৃহৎ কক্ষ নির্মিত হয়। এগুলি হল— নৃত্য কক্ষ, ‘নাটমন্দির’ এবং তার সামনে থাকে ‘ভোগমন্দির’। এই কাঠামোর মধ্যে সমস্ত অংশগুলি ধরা থাকে। সাধারণভাবে থামের পরিবর্তে দেওয়ালের ওপর ছাদ আঁটা থাকে। দেউলের শীর্ষদেশ পিরামিডের মতো ক্রমশ সরু হয়ে অনেক ওপরে উঠে সম্পূর্ণ হয় অনেক পরে। লিঙ্গরাজ মন্দিরের আদলে নির্মিত এই মন্দিরের আয়তন দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে ৩১০ ফুট × ৮০ ফুট। শিখরের উচ্চতা প্রায় ২০০ ফুট। চারটি অংশ সমন্বিত জগন্নাথ মন্দির একটি কাঠামোর মধ্যে নির্মিত হয়েছে। তবে প্রশস্ত নাট মন্দিরে ১৬টি থাম প্রযুক্তিগত কারণে ব্যবহার করা হয়েছে। মূল মন্দিরের চারপাশের প্রায় ৩০/৪০ টি ছোটো ছোটো মন্দিরে নানা বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত আছেন।
আদি-মধ্যযুগের জৈন স্মৃতিস্তম্ভগুলিও স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন হিসেবে উল্লেখের দাবি রাখে। স্মরণীয়, এমন দুটি স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাতা ছিলেন গঙ্গরাজা বা চতুর্থ রাকমল্ল’র মন্ত্রী চামুণ্ডা রায়। দুটিরই অবস্থান শ্রাবণবেলগোলায়। এর একটি ‘চামুণ্ডারায় বসদি’। চন্দ্রগিরি পাহাড়ের পাদদেশে স্থাপিত এই সৌধের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ হল যথাক্রমে ৭০ ফুট ও ৩৬ ফুট। এটি নির্মিত হয় আনুমানিক ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে। দ্বিতীয় শৌধটি প্রথম তীর্থংকরের পুত্র গোম্মত-এর উদ্দেশ্যে নিবেদিত এবং এর নির্মাণকাল ৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ।
রাষ্ট্রকুটদের আমলে শিল্পকলার বিশেষ অগ্রগতি ঘটেনি। রাষ্ট্রকুট আমলের একমাত্র শিল্পনিদর্শন হল ইলোরার ‘কৈলাসনাথ’ মন্দির। রাষ্ট্রকুটরাজ প্রথম কৃষ্ণের আমলে এটি নির্মিত হয়। এটি ছাড়া এমন কোনো ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়নি যা থেকে সন্দেহে করা যেতে পারে যে, সমগুরুত্বপূর্ণ কোনো শিল্পসৃষ্টি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। অবশ্য কৈলাসনাথ মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী শিল্পরসিকদের প্রভূত প্রশংসা অর্জন করেছে।