আধুনিক চীনের ইতিহাসে লং মার্চের তাৎপর্য
চীনে এক সময়ের সাম্রাজ্যবাদী শাসন, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, এবং সামরিক সংঘাতের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ছিল। ১৯২০-১৯৩০-এর দশকে, কুমিনতাং (Kuomintang) সরকার এবং কমিউনিস্ট পার্টি (Chinese Communist Party, CCP) এর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চরমে পৌঁছায়, যা দেশটির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে দাঁড়ায়। এই সংঘর্ষের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রতীকী মুহূর্ত ছিল লং মার্চ (Long March), যা ছিল চীনা কমিউনিস্ট পার্টির এক ঐতিহাসিক সামরিক অভিযান। ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যে, কুংমিনতাং বাহিনীর আক্রমণ থেকে বাঁচতে, কমিউনিস্টরা ২৫,০০০ মাইল দীর্ঘ এক রণনৈতি অভিযানে অংশ নেয়। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল তাদের নিজস্ব কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু, চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত যাংজি (Jiangxi) প্রদেশ থেকে পালিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখা। লং মার্চ চীনা ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যার রাজনৈতিক, সামরিক এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ছিল বিশাল।
১. লং মার্চের পূর্ব পটভূমি:
১৯২৭ সালে চীনা গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, যখন কুংমিনতাং (KMT) এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (CCP) মধ্যে সংঘর্ষের সূচনা হয়। কুংমিনতাং, চীনের মূল শক্তি হিসেবে, একদিকে শাসক শ্রেণির পক্ষে ছিল, এবং অন্যদিকে, সিংহভাগ জনগণের আস্থা ছিল CCP এর প্রতি, বিশেষ করে শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণির মধ্যে। প্রথমে CCP একটি গেরিলা যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন করে, কিন্তু ধীরে ধীরে কুংমিনতাং-এর সামরিক বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত শক্তিশালী আক্রমণ শুরু করে। ১৯৩৪ সালের অক্টোবর মাসে, কমিউনিস্টদের গেরিলা বাহিনী কুংমিনতাং এর আক্রমণ থেকে বাঁচতে, চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এরপর শুরু হয় লং মার্চ।
২. লং মার্চের নির্ধারক অভিযাত্রা:
লং মার্চের সময়, চীনা কমিউনিস্ট বাহিনীকে পরাস্ত করা অসম্ভব ছিল। তারা দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সরে যায়, পাহাড়, মরু এলাকা, বনজঙ্গল পার করে এবং নানা ধরনের শত্রু বাহিনীর সম্মুখীন হয়। এই অভিযানে বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা, রাজনৈতিক বাধা এবং অভ্যন্তরীণ সংকট ছিল, তবে তা সত্ত্বেও, কমিউনিস্ট বাহিনী তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। তবে, এই অভিযানে বহু যোদ্ধা প্রাণ হারায়, এবং সঙ্কটের সময় অনেক কমিউনিস্ট নেতা এবং তাদের অনুগামীদের মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বও সৃষ্টি হয়।
৩. লং মার্চের রাজনৈতিক তাৎপর্য:
লং মার্চের প্রধান রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল এটি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির জন্য এক নতুন জীবনের সূচনা। এই অভিযানের মধ্য দিয়ে, CCP-র নেতৃত্বে মাও সেতুং (Mao Zedong) প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরবর্তীতে চীনের কমিউনিস্ট বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মূল হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। যদিও এই অভিযানে অনেক বিপর্যয় ঘটে, তবুও এটি CCP-র মধ্যে একটি বৃহৎ ঐক্য তৈরি করে, যেখানে মাও সেতুং-এর নেতৃত্বকে একধরনের অক্ষুণ্ণ সমর্থন দেওয়া হয়।
এই অভিযানের সময়, মাও সেতুং তাঁর চিন্তাধারা এবং কৌশল প্রণয়নের মাধ্যমে CCP-কে একটি নতুন পথে নিয়ে যান। তিনি বোঝাতে সক্ষম হন যে, গেরিলা যুদ্ধ এবং কৃষক শ্রেণিকে যুক্ত করে বিপ্লবের শক্তি অর্জন সম্ভব। এই চিন্তাধারা পরবর্তী সময়ে চীনা বিপ্লবের পাথেয় হয়ে ওঠে, যার মাধ্যমে তিনি চীনের সমাজের মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন।
৪. লং মার্চের সামরিক তাৎপর্য:
লং মার্চ ছিল চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একটি মহাকাব্যিক সামরিক অভিযাত্রা। এই অভিযানে কুংমিনতাং বাহিনী, জাপানি সাম্রাজ্যবাদ, এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। বিশেষ করে, কুংমিনতাং এর অত্যন্ত শক্তিশালী সেনাবাহিনী কমিউনিস্টদের পিছু হটানোর জন্য একের পর এক আক্রমণ করেছিল, কিন্তু এর পরও কমিউনিস্টরা তাদের লড়াই চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। লং মার্চের ফলে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বাহিনী দীর্ঘমেয়াদে শক্তিশালী হয়ে ওঠে, কারণ এটি তাদের একটি গেরিলা যুদ্ধে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সাহায্য করেছিল।
এই অভিযানে কমিউনিস্ট বাহিনীর গেরিলা কৌশল এবং মাঠের যুদ্ধের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি চীনের যুদ্ধ কৌশলকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে আসে, যা পরবর্তীতে CCP-কে জাপানি আগ্রাসন এবং কুংমিনতাং এর বিরুদ্ধে আরও সফলভাবে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত করে তোলে।
৫. লং মার্চের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য:
লং মার্চ চীনের ইতিহাসে একটি সাংস্কৃতিক চেতনা তৈরি করে। এটি চীনের বিপ্লবী আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হয়ে ওঠে, যার মাধ্যমে সাধারণ জনগণ এবং কৃষকরা তাদের আত্মমর্যাদা এবং শক্তির অনুভূতি লাভ করে। এই অভিযানে মারা যাওয়ার পর, তাদের স্মৃতি চীনা জনগণের সংগ্রাম এবং কষ্টের ইতিহাসের একটি অংশ হয়ে ওঠে।
মাও সেতুং এবং তার সহযোগীদের বীরত্ব এবং সাহসিকতা চীনের বিপ্লবী চেতনায় এক নতুন স্পিরিট যোগ করে। লং মার্চের মাধ্যমেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টি জনগণের মনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, যা তাদের জন্য পরবর্তী দশকগুলোতে গণসমর্থন অর্জনের পথে নিয়ে যায়।
৬. লং মার্চের পরবর্তী প্রভাব:
লং মার্চের পর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কৌশল ও নেতৃত্বে মাও সেতুং-এর অবস্থান দৃঢ় হয়, যা পরবর্তীতে চীনা বিপ্লবের সফলতার মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৪৯ সালে, চীনা কমিউনিস্টরা গৃহযুদ্ধ জয়লাভ করে চীনের ক্ষমতা দখল করে, এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হয়। লং মার্চের দিকনির্দেশনা এবং প্রেরণা চীনের রাজনৈতিক এবং সামরিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উপসংহার:
লং মার্চ চীনা ইতিহাসে একটি বিশাল রাজনৈতিক, সামরিক, এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বহন করে। এটি শুধু চীনা কমিউনিস্ট পার্টির জন্য একটি মহাকাব্যিক অভিজ্ঞতা ছিল না, বরং এটি সমগ্র চীনা জনগণের জন্য এক সংকল্প এবং সংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠে। মাও সেতুং-এর নেতৃত্বে কমিউনিস্টদের ঐক্য, সংগ্রামী মনোভাব, এবং বিপ্লবী চিন্তাভাবনা পরবর্তী সময়ে চীনকে একটি নতুন দিশা দেখায়। লং মার্চ শুধু একটি সামরিক অভিযান নয়, বরং একটি জাতীয় ঐক্য, সংগ্রাম এবং বিপ্লবের প্রতীক ছিল, যা চীনা সমাজের অন্তর্নিহিত শক্তির পরিচায়ক হিসেবে পরিণত হয়।