আর্যদের ভারতে বসতি:
দীর্ঘদিন নিজ বাসভূমিতে বসবাসের পরে আর্যরা বহির্দেশে গমন করে। তাদের এই সমষ্টিগতভাবে দেশত্যাগের কারণ হিসেবে জনসংখ্যার বৃদ্ধি, খাদ্যাভাব, ভূমির অভাব, জলবায়ু পরিবর্তন এবং গৃহবিবাদ প্রভৃতি কারণের কথা বলা হয়। তাদের একটি অংশ অগ্রসর হয় পশ্চিমে ইউরোপের দিকে এবং অপর একটি অংশ অগ্রসর হয় পূর্বদিকে। যে অংশটি পূর্বদিকে অগ্রসর হয়, তারা প্রথমে পারস্যে বসতি স্থাপন করে। তারপর পারস্য থেকে তাদের একটি অংশ চলে যায় ভারতে। আর্যদের এই অভিপ্রয়াণ বা দেশান্তর গমন চলে দীর্ঘদিন ধরে কোনো এককালীন পূর্বপরিকল্পনার মাধ্যমে নয়। দীর্ঘদিন ধরে ছোটো-ছোটো দলে বিভক্ত হয়ে তরঙ্গের পর তরঙ্গের মতো তারা ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে এসে আঘাত হানে।
আদি ইন্দো-ইরানীয়রা বা আদি আর্যরা প্রথমে দানিয়ুব নদীর তীর ধরে ওয়ালাসিয়া এবং পরে আরও দক্ষিণে দার্দানেলেস ও বসফরাস প্রণালীর দিকে অগ্রসর হয়। পরে এই প্রণালী অতিক্রম করে তারা এশিয়া মাইনরের মালভূমিতে উপস্থিত হয়। এরপর তারা ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস অতিক্রম করে পারস্যে উপনীত হয়। পারস্যে তারা বেশ কিছুদিন বাস করে এবং এখানে তারা দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। একটি ইরানে থেকে গেল, অপর শাখাটি দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করল।
গিরিপথের মধ্যে দিয়ে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে আর্যরা প্রথমে আফগানিস্তান এবং পরে পাঞ্জাবে বসতি বিস্তার করে। ঋগ্বেদের প্রথম অংশে উত্তর-পশ্চিম ভারতের কয়েকটি পাহাড়-পর্বত, নদনদী ও স্থানের উল্লেখ আছে। ঋগ্বেদে কাবুল, গান্ধার, কুররম, গোমাল ও সপ্তসিন্ধুর উল্লেখ আছে। সপ্তসিন্ধু বলতে শতদ্রু, বিপাশা, ইরাবতী বা রাভি, চেনাব, ঝিলাম, সিন্ধু ও সরস্বতী নদীর অববাহিকা অঞ্চলকে বোঝায়। বর্তমানে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু, পাঞ্জাব নিয়ে গঠিত এই অঞ্চলকে ঋগ্বেদে ‘ঈশ্বরের দেশ’ বলা হয়েছে। ঋগ্বেদে হিমালয়-কাশ্মীরের শৃঙ্গ মুজবস্তের উল্লেখ পাওয়া যায়।
এ থেকে মনে করা হয়, এই অঞ্চলেই আর্যরা এসে প্রথমে বসতি স্থাপন করে। সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে আর্যদের বসতি স্থাপন একদমই সহজ ছিল না। স্থানীয় অনার্যদের সঙ্গে আর্যদের সংঘর্ষ বাধে এবং যুদ্ধে জয়ী হয়ে অর্থাৎ অনার্য তথা দস্যু বা দাসদের পরাজিত করে বসতি বিস্তারে সক্ষম হয়। কালক্রমে তাদের লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং পশুপালন ও কৃষিকাজের জন্য জমির দরকার হয় এবং আর্যদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ বাধে। তাই তারা ভারতের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। গঙ্গা-যমুনা বনাঞ্চল আগুনে পুড়িয়ে ও লৌহাস্ত্রের মাধ্যমে পরিষ্কার করে আর্যরা এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। এই ঋগ্বৈদিক যুগের শেষপর্যন্ত তারা সরযূ নদী বা মধ্যদেশ পর্যন্ত বসতি স্থাপন করে।
পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্যরা গঙ্গা অতিক্রম করে আরও পূর্বদিকে অগ্রসর হয়। আনুমানিক 1000 থেকে 800 খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে পূর্ব ভারতে আর্য আধিপত্য বিস্তৃত হয়। এই প্রাচী বা পূর্ব ভারতে আর্য সম্প্রসারণ সহজসাধ্য হয়নি। অনার্য দস্যুদের পরাজিত করতে হয়েছে।
মধ্যদেশের পশ্চিমে অবস্থিত মালব, সৌরাষ্ট্র, গুজরাট প্রভৃতি অঞ্চলে আর্য সভ্যতার সম্প্রসারণ হলেও এই অঞ্চলের মানুষের সম্পূর্ণ আর্যীকরণ সম্ভব হয়নি। যদিও পরবর্তীকালের বৈদিক সাহিত্যে পশ্চিম ভারতকে আর্যাবর্ত বা আর্যদের বাসস্থানের অংশ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
দাক্ষিণাত্যে আর্য সভ্যতার সম্প্রসারণ হয় অনেক দেরিতে এবং শান্তিপূর্ণ পথে। দ্রাবিড় সভ্যতার পীঠস্থান দক্ষিণ ভারতে আর্য সংস্কৃতি বিস্তারে আর্য ঋষি ও মুনিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। এ ব্যাপারে ঋষি অগস্ত্যের কথা বলা যায়। তবে দাক্ষিণাত্যে ‘শবর’, ‘পুলিঙ্গা’, ‘অল্প’ প্রভৃতি অনার্য জাতির অস্তিত্ব অতি প্রবল থাকাতে আজও আর্য সভ্যতা সম্পূর্ণ বিস্তৃত হয়নি।