ইউএসএসআর-এর শিল্প উন্নয়নে ক্রুশ্চেভ কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থা আলোচনা কর।

ইউএসএসআর-এর শিল্প উন্নয়নে ক্রুশ্চেভ কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থা:

নিখিত বস্তুতে, সোভিয়েত ইউনিয়ন (ইউএসএসআর)-এর শিল্প উন্নয়নে নিকিতা সের্গেইভিচ ক্রুশ্চেভ কর্তৃক গৃহীত নানা গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা এবং তাদের ফলাফলগুলি বিশ্লেষণ করা হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯৫৩ সালে স্ট্যালিনের মৃত্যু পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর, ক্রুশ্চেভ শাসনের নেতৃত্বে শিল্প উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনার নতুন দিকনির্দেশনা গ্রহণ করা হয়। তিনি শিল্পায়ন, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং সামরিক শক্তির আধুনিকীকরণের দিকে মনোযোগ দেন। তার শাসনামলে ইউএসএসআর-এর শিল্পে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক কাঠামোকে মজবুত করার উদ্দেশ্যে গৃহীত ছিল।

১. পরিকল্পনা শিল্পের আধুনিকীকরণ:

ক্রুশ্চেভের শাসনামলে সোভিয়েত শিল্পের আধুনিকীকরণ একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের শিল্প ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিকল্পনা এবং নতুন কৌশল প্রয়োগ করা হয়, যার মধ্যে প্রধানতম ছিল ৫ বছর মেয়াদি পরিকল্পনার পুনর্বিবেচনা এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে, সোভিয়েত ইউনিয়নকে দ্রুত শিল্পায়ন এবং উৎপাদনশীলতার লক্ষ্য নিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল। এই পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য ছিল কৃষির পাশাপাশি ভারী শিল্পের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, আধুনিক মেশিনারি ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি, এবং দ্রুত শহুরে শিল্পায়ন নিশ্চিত করা।

ক্রুশ্চেভ তাঁর নেতৃত্বে একদিকে কৃষি এবং খাদ্য উৎপাদনে উন্নতি সাধনের চেষ্টা করেন, অন্যদিকে ভারী শিল্পের পাশাপাশি হালকা শিল্পেও উন্নতি সাধনের জন্য উদ্যোগী হন। বিশেষ করে, তাঁকে শিল্প ক্ষেত্রের আধুনিকীকরণ এবং উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একটি বিশেষ প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে দেখা যায়।

২. রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠানের আধুনিকীকরণ:

ক্রুশ্চেভ তার শাসনামলে সোভিয়েত শিল্প ক্ষেত্রের আধুনিকীকরণের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি শিল্পের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের আধুনিকীকরণ এবং এর কার্যক্রমের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে প্রচেষ্টা চালান। এর মাধ্যমে, সোভিয়েত শিল্প উৎপাদন আরও উন্নত এবং দ্রুত বৃদ্ধি পায়। কৃষি এবং খাদ্য উৎপাদন ক্ষেত্রের পাশাপাশি, এ সময় বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, এবং গ্যাস ও তেল রিফাইনিং শিল্পে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, তা ছিল ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া এবং অন্যান্য সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোতে শিল্পের বিভিন্ন ধরণের আধুনিকীকরণের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল।

৩. সামরিক শিল্পে বিপ্লব:

ক্রুশ্চেভ শাসনামলে সোভিয়েত সামরিক শিল্পে একটি বিপ্লব ঘটেছিল। তিনি সামরিক শক্তির আধুনিকীকরণের জন্য ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করেন। এই সময়েই সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্ষেপণাস্ত্র এবং পারমাণবিক প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করে এবং এগুলি ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হতে সক্ষম হয়।

ক্রুশ্চেভের অধীনে, সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক শক্তি এবং ভূপৃষ্ঠে বা আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করার ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই সামরিক শিল্পের আধুনিকীকরণের ফলে ইউএসএসআর পরবর্তী দশকগুলিতে একটি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীতে স্থান পায়।

৪. কৃষি শিল্পে প্রযুক্তির ব্যবহার:

ক্রুশ্চেভ কৃষির ক্ষেত্রে আধুনিকীকরণকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৃষি ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারে জোর দেন। ১৯৫০-৬০-এর দশকে, ক্রুশ্চেভ কৃষির আধুনিকীকরণের জন্য নানান নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যেমন নতুন প্রযুক্তি, উন্নত যন্ত্রপাতি এবং বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে উৎপাদন বৃদ্ধি। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রদেশে উচ্চ উৎপাদনশীল কৃষি অঞ্চল গড়ে তোলার জন্য প্রচেষ্টা চালান, বিশেষত ঘাসের ক্ষেত্রগুলোতে।

ক্রুশ্চেভের প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ, কিছু ক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল, তবে তার অধিকাংশ পরিকল্পনা সফল হয়নি। বিশেষ করে, মাইলকোভের ক্ষেত্র এবং শস্য উৎপাদনে যথেষ্ট ফলপ্রসূ ফল পাওয়া যায়নি। কৃষির আধুনিকীকরণের জন্য তাঁর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অব্যাহত থাকলেও তিনি কৃষক-কর্মীদের জন্য সেভাবে পছন্দসই পরিবর্তন আনতে সক্ষম হননি।

৫. শিল্পে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা অপটিমাইজেশন:

ক্রুশ্চেভ শাসনের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল শিল্পে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ও অপটিমাইজেশন। তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যে, শিল্প উৎপাদন এবং সমন্বয়ের ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃত্ব শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং সেখানে উৎপাদন প্রক্রিয়া দ্রুতগতিতে কাজ করবে। এ জন্য, তিনি রাষ্ট্রীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলির সংখ্যা বাড়ানোর এবং তাদের কার্যক্রমে উন্নতি করার জন্য কাজ করেছিলেন। এর মাধ্যমে দেশের শিল্প উৎপাদন এবং সামগ্রিক অর্থনীতির গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।

৬. শিল্পের স্থানীয়করণ অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন:

ক্রুশ্চেভ শিল্পের স্থানীয়করণকে উৎসাহিত করেছিলেন। তাঁর পরিকল্পনা ছিল, শিল্পের উন্নয়ন শুধুমাত্র মস্কো বা লেনিনগ্রাদ (বর্তমানে সেন্ট পিটার্সবার্গ) কেন্দ্রিক না হয়ে, সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য প্রদেশে এবং অঞ্চলগুলোতে শিল্প গড়ে তোলা। এর ফলে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে ভারী শিল্প, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এবং অন্যান্য শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে। শিল্পের স্থানীয়করণের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটে।

৭. অর্থনৈতিক অবস্থা ফলাফল:

ক্রুশ্চেভের শাসনামলে সোভিয়েত শিল্পে একদিকে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আধুনিকীকরণ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা ঘটলেও, এর কার্যকর ফলাফল সেভাবে দেখা যায়নি। শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি হলেও অনেক ক্ষেত্রেই পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে কিছু সমস্যা দেখা দেয়, বিশেষ করে কৃষিতে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কিছু শিল্পে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং উৎপাদনের ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিত দেরি এবং খরচের সমস্যা তৈরি হয়েছিল।

তবে, সামগ্রিকভাবে ক্রুশ্চেভের শাসনামলে সোভিয়েত শিল্পের আধুনিকীকরণ এবং উন্নয়ন একটি নতুন দিশা পায়, যা পরবর্তী সোভিয়েত নেতাদের জন্য একটি পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।

উপসংহার:

ক্রুশ্চেভের শাসনামলে সোভিয়েত শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি সাধিত হলেও, তা কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ফল দেয়নি। তিনি শিল্পের আধুনিকীকরণ, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সামরিক শিল্পে আধুনিকীকরণকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তার নীতিগুলি সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক শক্তির আধুনিকীকরণ এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সহায়ক হলেও, কিছু ক্ষেত্রে তার পরিকল্পনা সফল হয়নি। তবে, সোভিয়েত ইউনিয়নের শিল্পায়ন এবং অর্থনৈতিক কাঠামো উন্নয়নে ক্রুশ্চেভের গৃহীত পদক্ষেপগুলি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলেছিল, যা পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading