উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কাকে বলে?

উদারনৈতিক গণতন্ত্র:

গণতন্ত্র সম্পর্কিত মৌলিক সংজ্ঞার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক ক্ষমতার অধিকারী হয় জনসাধারণ। জনসাধারণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই রাজনীতিক ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে। এই রাজনীতিক ক্ষমতার ব্যবহার তিন ধরনের হতে পারে। এই তিনটি ধরন হল: অংশগ্রহণ (participation), প্রতিযোগিতা (competition) এবং স্বাধীনতা (liberty)। সুতরাং গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ সংজ্ঞায়িত রূপ হল অংশগ্রহণ, প্রতিযোগিতা এবং স্বাধীনতার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতিক ক্ষমতার ব্যবহার।

গণতন্ত্রের এই সংজ্ঞা বিষয়ীগত। এই সংজ্ঞায় ব্যক্তিগত স্বাধীনতার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। গণতন্ত্রের এই সংজ্ঞা উদারনীতিবাদের মতাদর্শের সঙ্গে সামঞ্জসপূর্ণ। অনেক রাষ্ট্রদার্শনিক উদারনীতিক গণতন্ত্র (liberal democracy) প্রত্যয়টি প্রয়োগের পক্ষপাতী। এ হল এমন এক রাজনীতিক ব্যবস্থা যা ‘অংশগ্রহণ’, ‘প্রতিযোগিতা’ ও ‘স্বাধীনতা’-কে উন্নীত করে। উদারনীতিক মতাদর্শের মধ্যেই উদারনীতিক গণতন্ত্রের মূল নিহিত আছে। এই ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। উদারনীতিক মতাদর্শ এবং উদারনীতিক আর্থনীতিক রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রাধান্য বর্তমান থাকলে, তবেই উদারনীতিক গণতন্ত্র থাকবে এমন কোন অন্তর্নিহিত অপরিহার্য সম্পর্কের কথা বলা যায় না। সামাজিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় (social democratic regieme) ও উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্ভব। সামাজিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত অধিকারের উপর সমষ্টিগত কল্যাণকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং বৃহত্তর সাম্যের স্বার্থে ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এতদসত্ত্বেও উদারনীতিক গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয় অংশগ্রহণ, প্রতিযোগিতা ও স্বাধীনতাকে সামাজিক গণতন্ত্রে মর্যাদা দেওয়া হয়। বাজার ও সম্পত্তির ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সামাজিক গণতন্ত্রে স্বীকার ও সমর্থন করা হয়। বস্তুতঃ অংশগ্রহণ, প্রতিযোগিতা ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার জন্য উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কতকগুলি ভিত্তিমূলক প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা করা হয়। কিছু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত স্বাধীনতাসমূহের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আবার অন্যান্য গণতন্ত্রে সামাজিক ও জাতীয় উদ্দেশ্যসাধনের স্বার্থে স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করা হয়।

ঐতিহ্যগত উদারনৈতিক গণতন্ত্র:

উদারনৈতিক গণতন্ত্র হল এক বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এর মধ্যে উদারনৈতিক দর্শন, চিন্তা ও ভাবধারা প্রতিপন্ন হয়। পতান্ত্রিক পদ্ধতিতে উদারনৈতিক দর্শনের বাস্তবায়ন এর মূল লক্ষ্য। মোটামুটিভাবে সপ্তদশ শতাব্দীতে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার বিকাশ ঘটে। উদারনীতিক ভাবধারার সঙ্গে গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও ব্যবস্থা-পদ্ধতির সমন্বয় সাধনের উদ্যোগ কিছু রাষ্ট্রদার্শনিকের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদদের মতানুসারে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার বিকাশ সাধন ও সুরক্ষা সম্ভব। এ বিষয়ে ঐতিহ্যবাদী উদারনীতিবাদীদের মনে কোন সংশয় সন্দেহ ছিল না। উদারনীতিবাদের ধ্রুপদি প্রবক্তাদের মধ্যে জন লক, রুশো, মন্টেস্কু, মিল, বেস্থাম, হবহাউস প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। লক নিয়মতান্ত্রিক সরকার ও গণসম্মতির তাত্ত্বিক ধারণা উপস্থাপিত করেছেন। রুশো গণ-সার্বভৌমত্বের ধারণা তুলে ধরেছেন। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রবক্তা হিসাবে মন্টেস্কুর নাম রাজনীতি বিজ্ঞানে বিশেষভাবে উজ্জ্বল। মিল ব্যক্তি স্বাধীনতার দর্শনের উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। বেহাম সর্বাধিক মানুষের সর্বাধিক হিত সাধনের কথা বলেছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই এই সমস্ত ধ্যান-ধারণার বাস্তবায়ন সম্ভব। এই সাবেকী উদারনৈতিক গণতন্ত্রের দু’টি মূল নীতি হল রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতা। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকরা এ দু’টি নীতির স্রষ্টা হিসাবে পরিচিত। মধ্যবিত্ত শ্রেণী এই সাবেকী বা ঐতিহ্যগত উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছেন। হবহাউস-কে অনুসরণ করে ঐতিহ্যগত উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মূল নীতিগুলি উল্লেখ করা যেতে পারে।


(
) শাসনব্যবস্থায় জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ গণতান্ত্রিক নীতিকে সফল করে। প্রজ্ঞাশীল জীব হিসাবে ব্যক্তিমাত্রেরই রাজনৈতিক বিষয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা দরকার। সকলের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য এটা অপরিহার্য।

() উদারনৈতিক গণতন্ত্রে আইনের শাসনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ব্যক্তির পৌর স্বাধীনতা সংরক্ষণের স্বার্থে সকলের ঊর্ধ্বে আইনকে স্থাপন করা দরকার। 

() ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী দর্শনের ভিত্তিতে উদারনৈতিক গণতন্ত্রে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবাধ স্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয়। 

() উদারনৈতিক গণতন্ত্রে ব্যক্তির মর্যাদা ও স্বাধীনতার অধিকারকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার হিসাবে চিন্তার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রভৃতির কথা বলা হয়।

() এ ধরনের গণতন্ত্রে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সামাজিক জীবনে সকলের সমানাধিকারের কথা বলা হয়। এই ব্যবস্থায় সামাজিক স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। 

() নির্বাচন করার ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার উদারনৈতিক গণতন্ত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নীতি হিসাবে স্বীকৃত। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও গণ-সার্বভৌমত্ব এ ধরনের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি।

() এ ধরনের গণতন্ত্রে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয়। কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় না।

() উদারনৈতিক গণতন্ত্রে পারিবারিক জীবনের স্বাধীনতার উপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

() এ ধরনের গণতন্ত্রে জাতিগত সাম্য, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, আঞ্চলিক ও প্রশাসনিক স্বাতন্ত্র্যের কথা বলা হয়। 


(
) পুঁজিবাদের সম্প্রসারণের স্বার্থে উদারনৈতিক গণতন্ত্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি ও সহযোগিতার নীতিতে বিশ্বাসী। পরবর্তী কালে বেহাম, জেম্স মিল, জে. এস. মি. (John Stuart Mill) প্রমুখ দার্শনিক উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বিকাশ সাধন করেন। তার ফলে এই ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও হিতবাদের সুস্পষ্ট প্রভাবে পড়ে।


আধুনিক উদারনৈতিক গণতন্ত্রের অর্থ:

বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যে ধরনের উদারনৈতিক গণতন্ত্র প্রবর্তিত দেখা যায় তা পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা (western democratic system) হিসাবে পরিচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্য ইউরোপীয় দেশগুলিতে উদারনৈতিক গণতন্ত্র নতুন ভিত্তির উপর নতুন রূপ ধারণ করে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে ক্রমশ সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার অবির্ভাব ঘটে। বিংশ শতাব্দীতে ঐতিহ্যগত উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন ঘটে। জন ডিউই, মরিস র‍্যাফেল কোহেন প্রমুখ চিন্তাবিদ্ উদারনৈতিক গণতন্ত্রের আধুনিক রূপকে ব্যক্ত করেছেন। এঁরা উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে একটি ‘মনোভাব’ (attitude) ও ‘কর্মসূচী’ (programme) হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। ‘মনোভাব’ বলতে মানবসমাজের কাজকর্ম সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানসম্মত ও যুক্তিপূর্ণ পদ্ধতির প্রয়োগকে বোঝানো হয়েছে। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ‘কর্মসূচী’ হিসাবে তিনটি মূল নীতির কথা বলা হয়। এই নীতি তিনটি হল: 

  • (ক) প্রত্যেকের অবগতির জন্য জনগণের সঙ্গে সংযোগ সাধনের পথগুলি খোলা থাকবে। জনসাধারণ রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারবে। এবং পছন্দমত দলকে নির্বাচিত করতে পারবে। 
  • (খ) অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজনবোধে কিছু কিছু শিল্প-বাণিজ্যের জাতীয়করণ ও রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। 
  • (গ) সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য শিক্ষার বিস্তার ও প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার স্বীকার করা যেতে পারে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading