উদাহরণসহ কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার বৈশিষ্ট্য লেখো।

অথবা, নজরুলের কবি মানসের বৈশিষ্ট্য | নজরুল এক বিচিত্র কাব্য ভাবনার অধিকারী, –আলোচনা করো।

অথবা, রবীন্দ্রোত্তর কবিগণের মধ্যে নজরুলই একমাত্র গতিশীল জনপ্রিয় কবি,– আলোচনা করো।

উদাহরণসহ কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার বৈশিষ্ট্য

নজরুল নিজেই একটি আলাদা জগৎ তৈরি করেছিলেন যে তাঁর ভাবের জগৎ সংগ্রামের জগৎ-সাম্যবাদের জগৎ।

ভূমিকা : রবীন্দ্রনাথ তখন বাংলা সাহিত্যের মধ্যগগনে। ভারতবর্ষ তখন রবীন্দ্রনাথকে শ্রেষ্ঠ কবি ও গুরুদেব বলে বরণ করে নিয়েছে। সেই একচ্ছত্র উজ্জ্বল অপ্রতিদ্বন্দ্বী রবীন্দ্র-সাম্রাজ্যে পৃথক একটি স্বাধীন ভূখণ্ড স্থাপনের জন্য যাঁরা প্রথম সংগ্রামী চেতনার প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য অগ্রগণ্য নজরুল তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ।

রবীন্দ্রোত্তর যুগে রবীন্দ্র-বিরোধীতায় প্রথমে যে তিনজন কবির মৌলিক পথে যাত্রা করার দুঃসাহস দেখেছি তাঁরা হলেন, মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ও কাজি নজরুল ইসলাম। মোহিতলাল ইন্দ্রিয় সচেতন ভোগবাদ সর্বস্ব মানব জীবন পিপাসার সুন্দরময় অভিব্যক্তি। বাস্তব জীবনের অসঙ্গতি দুঃখ ও নৈরাশ্যের হাহাকার, ঈশ্বর বিদ্রোহী চেতনার সার্থক রূপকার ইঞ্জিনিয়ার কবি যতীন্দ্রনাথ। আর প্রচলিত লালিত বাণীর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে যিনি অগ্নি বীণার বিদ্রোহের সুরু ও কণ্ঠে বিশেষ বাঁশি বাজিয়ে ভাঙার গান গেয়েছিলেন, যুগান্তরের গোধূলি লগ্নে সেই মানবতাবাদী কবি নজরুল রাতারাতি জনমানসের দরজায় উপস্থিত হয়েছিলেন। আমরা যুগাস্ত বলেছি এই কারণে যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বব্যাপী চরম ধাক্কা খাওয়া যে চেহারা তা মানব সভ্যতার নিকট একটি নূতন হুঁশিয়ার।

এই সময় যুদ্ধ চলাকালীন তাঁর বলাকা কাব্যে ‘নবীন প্রাণ’ ও সবুজ তাজা হৃদয়ের বন্দনা গেয়ে ‘বন্দরের কাল হল শেষ’ বলে যে ঘোষণা করেছিলেন তাঁর অগ্নি স্বাক্ষর প্রখরভাবে দাবানল হয়ে ছাড়িয়ে পড়ল বিংশ শতাব্দীর কবি বিদ্রোহী নজরুলের হৃদয়ে—হাবিলদারী জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ও তার অবসান ঘটিয়ে—’ঝড়ের মাতন বিজয় কেতন নেড়ে’ ‘অট্টহাস্যে আকাশ খানি কেড়ে’ বাংলা কাব্য পদাপীঠে নূতন সংযোজিত সুর ও বাণীর এক উচ্ছ্বসিত আবেগ মন্থর বিপ্লব ঘটালেন। জীবনের উপছে পড়া পেয়ালায় এক বিচিত্র অম্লমধুর স্বাদ ওই শতাব্দীর আর কোনো কবির কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়েছে বলে মনে হয় না। জীবন মরমী এই কবি রবীন্দ্র ভাবশিষ্য হয়েও বলরামের চেলা হয়ে পৃথিবী কম্পিত করতে চেয়েছিলেন। সাহিত্যের দরবারে চিরদিনের আজন্ম লালিত সংসার ত্যাগ করে নূতন উন্মাদনার যে প্রবল বার্তা বহন করে এনেছিলেন তা আধুনিককাল ও জীবনের সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ। প্রথম মহাযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত যুগের বাংলাদেশের আশা-আকাঙ্ক্ষা ব্যাথা-নৈরাশ্য ও বিদ্রোেহ বিক্ষোভে সৰ্ব্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিত্ব অর্জনের দাবিদার নজরুল। রবীন্দ্র বিরোধীতার প্রথম বলিষ্ঠ সোচ্চার কবিকণ্ঠ তাঁরই।

তাঁর পূর্বে আর কোনো কবি জনজীবনের সঙ্গে কাব্যকে এমন সার্থকভাবে যুক্ত করবার গৌরব দাবি করতে পারেননি। জনজাগরণের জন্য কবি জনজাগরণের যে কতখানি প্রয়োজন ছিল তার দৃষ্টান্ত তিনি নিজেই। লাঙল পত্রিকার মাধ্যমে লোকজীবনের বলিষ্ঠ মানসিকতার এক সাংকেতিক ব্যাপ্তি ঘটেছে। বাংলা কাব্যে তরুণ বিদ্রোহ, পৌরুষ ও যৌবনের অগ্রগণ্য ভাব্যকারদের তিনি অন্যতম কবি মানস। অসহিষ্ণু আবেগ, বাঁধনহারা চৈতন্য জীবন প্রাতের বেপরোয়া কাব্য আহ্বান এবং মিলিটারি মেজাজে আপোষহীন, জেহাদহীন ঘোষণার বাণীছন্দ তাঁর কবি প্রকৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীর বুকে স্বাধীনভাবে চলার অধিকার চেতনা নজরুলের কবি প্রাণকে উত্তাল করেছিল বলেই কাব্যের ছন্দে ছন্দে এতো ক্ষোভ বিক্ষোভ জ্বালা ও যন্ত্রণা। জীবনের ইতিহাস দুর্বিষহ হতে পারে কিন্তু তার চেয়েও মর্মান্তিক হয় কবি প্রাণ যখন সেই যন্ত্রণা ও পরাধীনতার শিকার হয়ে পড়ে।

আধুনিক বাংলা কাব্যে তাঁর বিদ্রোহী সভা সম্বন্ধে আমরা সকলে সজাগ। কবি এই বিদ্রোহী রূপের মধ্যে দেশপ্রেম, সমাজনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি প্রভৃতি বিষয়কে আশ্রয় করে যে নৈরাশ্যের আশা ও স্বপ্ন কাব্য রূপ পেয়েছে তা তাঁর কাব্য ধারায় একটি পর্যায়। আর দ্বিতীয় ধারায় তিনি বিদ্রোহী নন, সাম্যবাদের মন্ত্রশিষ্য নন, এখানে তিনি প্রেমিক রূপে পরিচালিত—মানবিক প্রেম, বাৎসল্য ও প্রকৃতি প্রেমে চিরদিনের এক উপাসক কবিসস্তান, দোলনচাঁপা, ছায়ানট, পূবের হাওয়া ও সিন্ধু হিল্লোলের মধ্যে তাঁর প্রেমিক হৃদয় কল্লোলিত হয়েছে। তাঁর কবিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন—’আমার সুন্দর এলেন কবিতা হয়ে’। এই সুন্দরের সাধনা সব প্রেমিক কবির সাধনা। তৃতীয় ধারায় জীবনী বিষয়ক কবিতাগুলি ঠাঁই পেয়েছে যার মধ্যে এক অখণ্ড কবিমানস স্বতই প্রকাশিত। যেমন—চিতনামা মরুভাস্কর, এই বিভিন্ন ধারা কাব্য স্ফূর্তির প্রকাশের মধ্যেই কবি যেন পৃথিবীর এক ক্ষুদ্র মানব সন্তান যিনি তাঁর মাতৃঋণ শোধ করতে চান কিছুটা কাব্য ও শিল্প সাধনার মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কোনো কবি এমন করে আত্মসমর্পণের জন্য সাহিত্য শিল্পের কাছে নতজানু হয়নি। তিনি বলেছেন—পৃথিবীর ঋণ ভারতের ঋণ, বাংলার ঋণ, মানব ঋণ তোমার আত্মার আত্মীয়ের ঋণ সম্পূর্ণ রূপে শোধ না করে কেউ যেন না যেতে পারে। এই আর এক ভারত চেতনার মূর্ত উদ্যোক্তা, কবি নজরুল যা মানব চেতনার আর এক বিকল্প রূপ।

নজরুলের মধ্যে আমরা কয়েকটি কবিচেতনার প্রকাশ দেখি, যেমন—(ক) স্বদেশ চেতনা (খ) প্রকৃতি চেতনা-সুন্দরের ভাবনা (গ) প্রেম চেতনা (ঘ) সাম্যবাদ চেতনা (ঙ) মানবতাবাদ। আবার এই চেতনাগুলি বিশেষ করে স্বদেশ চেতনা ও মানবতা চেতনা নানা ছদ্মবেশে তাঁর কবি চেতনার মধ্যে উঁকি দিয়েছে। এগুলি হল রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মনৈতিক। কবি নজরুল-এর আগমনই হল পরাধীন ভারতবর্ষের মুক্তি কামনার স্বপ্ন ও সংগ্রাম নিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণ ও শাসনে অত্যাচারিত ভারতবাসী যে নবদিগন্তে উদয়কালের শুভ সূচনা কামনা করেছে তার সপক্ষে ইংরেজের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন তিনি। যে ইংরেজ নরশোষক ও মানবতাবিরোধী শাসক বলেই তাই তিনি সেইদিন শান্ত হবেন। “যেদিন উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না। “সামাজিক বৈষম্য, বহুজাত ও বর্ণে বিভক্ত ভারতবর্ষে নূতন কথা নয়, বিশেষ করে এই পুরুষশাসিত সমাজে যেখানে অর্ধেক নারী, যেখানে তার প্রতি পুরুষের এত অত্যাচার ও শোষণ তা কবিপ্রাণকে উদ্বেল করে তুলেছে। সেই কারণে তিনি নারী বন্দনা করেন, বারবনিতা বন্দনা করেন। পুরাণ শাস্ত্র থেকে নথিপত্র উদ্ধার করে সমাজেই চলেছে ধনী-দরিদ্রের আপোষহীন গুপ্ত লড়াই। যার অনিবার্য করুণ পরিণতি অর্থনৈতিক দুরবস্থা। যে মানব সংসারে শিক্ষা নেই, আলো নেই, অন্ন নেই, জ্ঞান নেই—সেই সংসারে সমাজ তার কাছে অভিশাপ। এই যে দারিদ্র্যের অভিশাপ, মৃত্যুর অভিশাপ—এ বাঙালির গতিশীল জীবনযাত্রাকে ব্যঙ্গ করেছে। তামাসার পাশা খেলায় পরিণত করেছে। কবির বিদ্রোহ সেখানে, যেখানে ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ ক্ষুধিত সমাজ চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন, সেখানে অমৃতের সন্তান বলে পরিচয় দিতে গেলে হাস্যকর হয়। নজরুল স্বরাজ চায়, স্বাধীনতা চায়, কিন্তু তিলে তিলে অন্নহীন মহামারীর দরখাস্তে নজিরবিহীন স্বাক্ষর করে নয়। ধর্ম ভারতবর্ষের প্রাণ ঐতিহ্য, ও রক্তগত সংস্কার। ভারতবর্ষ কোনো ধর্মের দেশ নয়। যুগে যুগে কালে কালে বিশ্বের নানা জাতি নানা ধর্মের আগমন ঘটেছে এবং ভারতের জীবনীশক্তিকে উজ্জীবিত করেছে–হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, পারসিক, জৈন্য ও খ্রিস্টান সমুদ্র তরঙ্গের মতো এই ভারতের মাটিতে উত্তোলিত ও বিলীন হয়েছে। বিশেষ করে হিন্দু মুসলমানের ধর্মীয় সম্পর্ক ও সমস্যা একটি জাতীয় সমস্যা। দাঙ্গা-হাঙ্গামা হনন একটি নিয়মিত চালচিত্র হয়ে উঠেছিল প্রায়। নজরুল তাঁর উদার কবিমানসের মধ্য দিয়ে এই বিভেদকামী সাম্প্রদায়িক দুষ্ট চক্রকে তীব্র করাঘাত আঘাত করেছেন। তিনি নিজে বলেছেন মৌলানা সাহেব ও নারদ মুনির দাড়ির প্রতিযোগিতা হলে কে যে হারবেন বলা মুশকিল। তিনি আরও বলেন—‘সবচেয়ে কাছে যারা থাকে দেবমন্দিরের সেই পান্ডারা দেবতার সবচেয়ে বড়ো ভক্ত নয়। বাঙালি সমাজে এই ধর্মীয় ভেদবুদ্ধি তাঁকে আতঙ্গগ্রস্ত করে তুলেছে। তাই তিনি কল্যাণ মন্ত্র উচ্চারণ করেন—‘নাই দেশ কাল পাত্রের ভেদ/অভেদ ধর্মনীতি/সবদেশ সবকালে তিনি ঘরে ঘরে মানুষের জাতি। অথবা ‘মানুষের ঘৃণা করি। যারা কোরান বেদ বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি।

দেশের তরী যখন ডোবে তখন মৌলবাদীরা প্রশ্ন করে হিন্দু না ওরা মুসলিম’ কবি বলেন—’ডুবিছে মানুষ সস্তান মোর মার। কাল মার্কস বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণে সমাজ ব্যবস্থাপনায় এক নূতন বিপ্লব আনলেন। আজকের দিনে তার প্রয়োগ বুদ্ধি নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও নজরুলের সময় তাঁর দাপট ছিল অবিসংবাদিত। সমাজ ব্যবস্থায় মূল ত্রুটি শোষক শোষিতের সম্পর্কের মধ্যে। যতক্ষণ না উৎপাদন ব্যবস্থার লাভভিত্তিক সমবর্তন হচ্ছে ততক্ষণ সমাজব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। বুর্জোয়া সমাজ শোষণের পক্ষপাতি থাকবেই। তাই তিনি বলেন, “প্রার্থনা করো, যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস। যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ।” মানুষের সমান অধিকার নিয়ে তিনি সাম্যের গান গাইলেন।–“গাহি সাম্যের গান।/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু গরীয়ান।”

কবি মানবতাবাদী এই প্রসঙ্গে কোনো অত্যাবশ্যক আছে বলে মনে করে না। কিন্তু তবুও নজরুল এত স্পষ্ট জোরালো কণ্ঠে মানুষের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ বিশ্বাস ও একনিষ্ঠ আস্থা স্থাপন করেন যা আমাদের প্রতি মুহূর্তে তাঁর মানব ঐশ্বর্য্য সম্পর্কে সজাগ করে দেয়। তিনি ধর্মকে দুইভাবে আশ্রয় করেছেন মানবতার সপক্ষে। প্রথমত, বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রের উদার মহানুভবতা, যে নিছক ধর্ম সংস্কারের অনেক উপরে তার সূত্র সন্ধান। দ্বিতীয়ত, সেই পুরাকালে সূত্র সন্ধানে ব্যপৃত কিছু ধর্মবুদ্ধি মৌলবাদী ধর্মগুরুদের উদ্দেশ্য প্রণোদিত পেশাদারি ফতেয়াকারী, যাঁরা বৃহত্তর মানবিক কল্যাণকে বিপথগামী ও বিপদগামী করেছে। কবি এ সম্পর্কে সচেতন বলে উচ্চারণ করেন—“যত পাপী তাপী সব মোর বোন সব মোর ভাই। “এবং ঘোষণা করেন—“আমরা সৃজিব নূতন জগৎ আমরা গাহিব নূতন গান।”

চির তারুণ্য সবুজ মহাবিপ্লবে কবি পুরোহিত নজরুল বাংলার একমাত্র চারণ কবি। বাংলার দুর্যোগময় ঘনঘটার দিনে নিজের লেখনীকে একই সঙ্গে জ্বলন্ত তরবারি ও ফুটন্ত তুলি করে তুলেছিলেন। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন—“তাঁর মধ্যে বাংলাদেশের সাধক বা মহাজনকে লক্ষ্য করেছিলাম।” আমরা বলতে পারি বিচিত্র কবি মানবের অধিকারী নজরুল বাংলা কাব্য সাহিত্যে এক দুরস্ত নায়েগ্রা জলপ্রপাত। বাঁধন হারা—বাঁধনই তাঁর মূল মস্ত্র-কাব্য মন্ত্র।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading