উপন্যাসে বর্ণিত সুবর্ণলতার ধ্যানধারণা যে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই- বক্তব্যটি পরিস্ফুট করো।

সুবর্ণলতা’ উপন্যাসে বর্ণিত সুবর্ণলতার ধ্যানধারণা যে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই – বক্তব্যটি পরিস্ফুট করা:

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখিকা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর সুবর্ণলতা’ উপন্যাসে একজন নারীর জীবন ও তার মানসিক বিকাশের কাহিনী অত্যন্ত নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করেছেন। সুবর্ণলতা, এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র, যে একদিকে সমাজের পুরনো রীতিনীতি ও প্রথাগত ধ্যানধারণায় বাধ্য হয়ে জীবনযাপন করে, অন্যদিকে তার মধ্যে এক অজানা আকাঙ্ক্ষা, স্বাধীনতা এবং আত্মবিশ্বাসের ঝিলিকও দেখা যায়। তবে, যে ধ্যানধারণায় সুবর্ণলতা বিশ্বাস করে এবং যেটি তার জীবনে প্রতিফলিত হয়, তা মূলত তার পিতৃকুল এবং মাতৃকুলের কাছ থেকে প্রাপ্ত এক ধরনের উত্তরাধিকার, যা তাকে সমাজের অবিচলিত সীমার মধ্যে বসিয়ে রাখে।

এই বক্তব্যের মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই যে, সুবর্ণলতার ধ্যানধারণা মূলত তার পারিবারিক পরিসরের মধ্যে তৈরি হয়েছে এবং সে তার পারিবারিক পরিবেশ এবং সামাজিক সম্পর্কের মাধ্যমে এগুলো শিখেছে। এর মানে হলো, তার চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধ এবং জীবনবোধের ভিত্তি তার পরিবার এবং সমাজের ঐতিহ্যপূর্ণ ধারার মধ্যেই নিহিত। সে যেমন পরিবারকে প্রথমে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, তেমনি নারীর জন্য নির্দিষ্ট সামাজিক দায়িত্ব পালন করাকে নিজের কর্তব্য মনে করে। এই সমস্ত ধ্যানধারণা তাকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়ে থাকে এবং তার জীবনযাত্রায় তা গভীরভাবে প্রভাব ফেলে।

পারিবারিক প্রভাব এবং সমাজের মূল্যবোধ:

সুবর্ণলতার ধ্যানধারণা পরিবার থেকেই প্রভাবিত হয়েছে। তার পরিবার ছিল ঐতিহ্যগত ও গোঁড়া, যেখানে নারীর জন্য সমাজের নির্ধারিত শাসনব্যবস্থা এবং মূল্যবোধ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার মায়ের মতো, যা ছিল নারীর সবচেয়ে বড় কর্তব্য—স্বামী এবং সন্তানদের সেবা করা, তাদের দুঃখে আনন্দে শাস্তি ভোগ করা। এটি একটি পুরনো সামাজিক রীতি, যেখানে নারীকে এক ধরনের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। সুবর্ণলতা এই একই ধরনের ধ্যানধারণা তার পিতৃকুল এবং মাতৃকুল থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে।

এমনকি সুবর্ণলতার মা-ও তার পিতৃকুলের সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করতে করতে বড় হয়েছেন। মায়ের মধ্যে সমাজের প্রতি এক প্রবল কর্তব্যবোধ ছিল, যার ফলে তিনি নারীর স্বাধীনতার ধারণা খুব একটা গ্রহণ করতে পারেননি। সেই মূল্যবোধই তাঁর মেয়ে সুবর্ণলতার মনে গেঁথে গেছে। আবার, সুবর্ণলতার বাবা ছিলেন সমাজের এক প্রথাগত ধারক, যারা তার মেয়ে ও স্ত্রীর প্রতি এক ধরনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই কর্তৃত্ব ছিল নারীর জীবনধারার কেন্দ্রবিন্দু, এবং তিনি যে পিতৃতন্ত্রের এক অনুকরণীয় আদর্শ ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না।

এই পরিবারের গঠন এবং ঐতিহ্যই সুবর্ণলতার জীবনের প্রথম শিক্ষা। শিশুকাল থেকেই সে তার মায়ের কাছ থেকে, এবং তার পিতৃকুলের কাছ থেকে এমনসব মূল্যবোধ অর্জন করেছে, যা তাকে সমাজের প্রতি আত্মত্যাগী, আদর্শ নারী হিসেবে তৈরির জন্য চালিত করেছিল। ফলে, সুবর্ণলতার ভাবনা এবং তার জীবনের দর্শন পুরনো সামাজিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

নারীর স্বতন্ত্র পরিচয় আত্মবিশ্বাসের অভাব:

সুবর্ণলতার মনের মধ্যে, তার পরিবারের এই প্রতিপাদ্য মূল্যবোধের ফলস্বরূপ, নারীর স্বাধীনতা এবং আত্মবিশ্বাসের প্রতি এক ধরনের শূন্যতা ছিল। তাকে কখনো নিজের স্বতন্ত্র চিন্তাভাবনা, ইচ্ছা ও অনুভূতির প্রতি গুরুত্ব দিতে শেখানো হয়নি। বরং তাকে শিখানো হয়েছিল, নারীর জীবনের উদ্দেশ্য হল তার স্বামী, সন্তান এবং সংসারকে আগলে রাখা। নারীর স্বাধীনতার ধারণা তার জীবনের কোনো অংশে ছিল না। এখানে একটি বড় প্রশ্ন উঠে আসে—সুবর্ণলতা কি কখনো নিজেকে জানতে বা চেতনা লাভ করতে পেরেছিল? সে কখনো নিজের আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে পেরেছিল কি?

এ প্রশ্নটির উত্তর ‘না’। একেবারে শৈশব থেকে তাকে যে প্রথাগত সমাজে বড় হতে হয়েছিল, সেখানে নারীর জন্য কোনো স্বাধীনতা বা স্বাধীনভাবে নিজের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত করার উপায় ছিল না। ফলে সুবর্ণলতা এক ধরণের নিঃসঙ্গতা এবং শূন্যতার মধ্যে বন্দী ছিল। তার জীবনে স্বপ্ন এবং উপলব্ধি ছিল মেধাহীন, কারণ তার চিন্তাভাবনা ও দর্শন সমাজের আগেই নির্ধারিত ছিল। এই চিন্তাভাবনা এবং মানসিকতা তাকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয়েছিল এবং তা তার জীবনের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

প্রথম প্রেম সমাজের প্রতিবন্ধকতা:

তবে, সুবর্ণলতা তার জীবনের এক পর্যায়ে এক নতুন ধ্যানধারণার সঙ্গে পরিচিত হয়, যখন তার জীবনে প্রেম আসে। কিন্তু এখানেও সে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়। তার প্রথম প্রেম তার মনের অচেতন গহীনে ঘুরপাক খাচ্ছিল, কিন্তু সে জানতো না এই প্রেম সমাজের বিধি-নিষেধের বাইরে বেরিয়ে যাবে কিনা। তার প্রেম তখন একটি নিষিদ্ধ আর সমাজের চোখে ‘অবৈধ’। সে প্রেমের মাধ্যমে যদি নিজের স্বাধীনতা অর্জন করতে চায়, তবে তার পরিণতি সমাজে কী হতে পারে?

এভাবেই, এই প্রেম এবং তার পরবর্তী পরিস্থিতি সুবর্ণলতার মধ্যে এক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে, কারণ তাকে পুরনো সমাজের মূল্যবোধ এবং নতুন উপলব্ধির মধ্যে এক কঠিন পরিসরে দাঁড়াতে হয়। সে জানে না যে, সে কি সমাজের নতুন ধ্যানধারণায় নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, না কি পুরনো ধ্যানধারণার মধ্যে আবদ্ধ থাকবে।

উপসংহার:

সুবর্ণলতা’ উপন্যাসে সুবর্ণলতার ধ্যানধারণা যে তার পরিবার এবং সমাজ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত, তার প্রমাণ প্রখরভাবে উঠে এসেছে। তার জীবনের মূল্যবোধ, চিন্তা ও অনুভূতি তার পিতৃকুল এবং মাতৃকুলের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। এই প্রথাগত সমাজের কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে সে কখনো নিজের স্বাধীনতা এবং আত্মবিশ্বাসের প্রতি মূল্য দিতে পারেনি, যদিও তার মধ্যে নতুন কিছু করার আকাঙ্ক্ষা ছিল। তবে, এক্ষেত্রে লেখক আমাদের দেখিয়েছেন যে, সামাজিক কাঠামো এবং পরিবারের ঐতিহ্য কতটা বড় ভূমিকা পালন করে এক নারীর জীবনে, বিশেষত তার মানসিকতা এবং জীবনের ধ্যানধারণা গঠনে।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading