‘নারীবাদী’ (feminist কথাটির প্রচলন পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু আধুনিক নারীবাদের উদ্ভব ঘটেছে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে। এই সময় প্রাথমিক পুঁজিবাদের বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। পুঁজিবাদের বিকাশের প্রাথমিক পর্বে আইনগত ও আর্থনীতিক পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের পরিবর্তনের কারণে মহিলাদের অবস্থার অবনতি ঘটে। এই সময় পুরুষের স্বৈরাচারী ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া স্বরূপ উদারনীতিক ধ্যান-ধারণার অভিব্যক্তি ঘটে। মহিলাদের রাজনীতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উদারনীতিক চিন্তাবিদ্রা সোচ্চার হন। ১৭৯২ সালে ফরাসী বিপ্লবের গোড়ার দিকে মেরী উলস্টোনক্রাফট (Mary Wollstonecraft)-এর Vindication of the Rights of Women শীর্ষক গ্রন্থটি প্রণীত হয়। প্রথম এই গ্রন্থটির মাধ্যমে প্রাথমিক উদারনীতিক নারীবাদের পরিপূর্ণ অভিব্যক্তি ঘটে। এই সময় মহিলাদের ভোটাধিকারতো ছিলই, এমনকি শিক্ষার অধিকারও ছিল না। অনেক বৃত্তি থেকে মহিলারা বঞ্চিত ছিল। আইনগত অবস্থানের বিচারে শিশুদের সঙ্গে মহিলাদের তেমন উপার্জনের উপর স্বামীর পরিপূর্ণ অধিকার স্বীকৃত ছিল। নির্যাতিতা হলেও স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদের ছিল না।
অধিকার “উদারনীতিক নারীবাদের দার্শনিক ভিত্তি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধ্যান-ধারণার মধ্যে নিহিত আছে। অনুসারে সকল ব্যক্তি-মানুষ সমগুরুত্বসম্পন্ন। সকল ব্যক্তির নৈতিক মূল্য সমান। জাতি, ধর্ম, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সমমর্যাদা প্রাপ্য। উদারনীতিবাদীদের মতানুসারে রাজনীতিক কারনে সকলের অংশগ্রহণের অধিকার আছে। এ ক্ষেত্রে মহিলাদের বিরুদ্ধে যে কোন ধরনের দৈয়া বা বঞ্চনামূলক আচরণ প্রতিহত করা প্রয়োজন। যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিচার-বিবেচনা করা দরকার। ব্যক্তি-মানুষের প্রকৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি, গুণগত যোগ্যতা বিচার্য বিষয় হওয়া বাঞ্ছনীয়।
উদারনীতিক নারীবাদ প্রধানত সংস্কারমূলক প্রকৃতির। এই শ্রেণীর নারীবাদীরা জনজীবনের ক্ষেত্রসমূহে নারী-পুরুষের মধ্যে সমপ্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ-সুবিধাকে উন্মুক্ত করার পক্ষপাতী। জগরদিকে অনেক নারীবাদী সমাজের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকে আক্রমণ করার কথা বলে থাকেন। উদারনীতিক নারীবাদীরা সাধারণত জীবনের সর্বসাধারণ ও ব্যক্তিগত (public private) ক্ষেত্রসমূহের মধ্যে পার্থক্যের বিলোপ সাধনের পক্ষপাতী নন। তাঁরা সংস্কার সাধনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। সর্বসাধারণের ক্ষেত্রসমূহে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠাই হল এর মূল লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে শিক্ষার অধিকার, ভোটাধিকার, স্বাধীনভাবে বৃত্তি গ্রহণের অধিকার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ ক্ষেত্রে বিশেষত, পশ্চিমী দেশগুলিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জনের উদাহরণ অনস্বীকার্য। এতদ্সত্বেও ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষেত্রসমূহে, পরিবারের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারের বিন্যাস, লিঙ্গগত শ্রমবিভাজন প্রভৃতি ক্ষেত্রে তেমন নজর দেওয়া হয়নি। প্রাথমিক উদারনীতিক নারীবাদের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে মেরী উলস্টোনক্রাপ্ট (Mary Woll-stonecraft) প্রণীত Vindication of the Rights of Women (১৭৯২) শীর্ষক গ্রন্থটিতে। এই গ্রন্থটি প্রথম ও প্রধান নারীবাদী গ্রন্থের মূল পাঠ হিসাবে পরিগণিত হয়। এই মহিলা সমাজবিজ্ঞানী যুক্তিসহকারে বলেছেন যে, মানুষ হিসাবে পুরুষদের মত মহিলারাও সমান অধিকার ও বিশেষাধিকারসমূহ পাওয়ার হকদার। মহিলাদের শিক্ষার অধিকার দেওয়া সরকার এবং নিজেদের অধিকারের জোরেই মহিলাদের যুক্তিবাদী জীব হিসাবে স্বীকার করা আবশ্যক। তাহলেই রাজনীতিক ও সামাজিক ক্ষেত্র লিঙ্গগত পার্থক্য গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। মহিলাদের হীনতর অবস্থান সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বাতিল করে দিয়েছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী পুরুষদের মত মহিলারাও হল যুক্তিবাদী ব্যক্তি। সুতরাং মহিলাদের সমানাধিকার থাকা উচিত। শিক্ষা, চাকরি, সম্পত্তি, ভোট প্রভৃতি ক্ষেত্রে মহিলাদের সমানাধিকারের ব্যাপারে তিনি সোচ্চার হয়েছেন। অধ্যাপিকা ভ্যালেরী ব্রাইসন (Valerie Bryson ) তাঁর Feminism শীর্ষক এক রচনায় এ প্রসঙ্গে বলেছেন : “Half a century later, these principles found concrete expression at the first ever Women’s Rights Convention hold at seneca Falls in America in 1848, and the latter part of the nineteenth century saw the growth of equal rights feminism | throughout the industrializing world.” অধ্যাপক অ্যানড্রু হেউড (Andrew Hey- feminism drew upon an Enlightenment liberal belief in reason and a Mood) তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন : “Wollstonecraft’s radical humanist commitment to equality. She stressed the equal rights of women, specially in education, on the basis of the notion of ‘personhood”.”
সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ কমন্সসভায় নারী ভোটাধিকারের প্রশ্নটি পেশ করেন। সহযোগী লেখক হ্যারিয়েট টেলর (Harriet Taylor)-এর সঙ্গে লিখিত জে. এস. মিলের On the Subjection of Women শীর্ষক বিখ্যাত গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ সালে। এই গ্রন্থটিতে মহিলাদের অবস্থা সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়। তা ছাড়া সমাজের স্বার্থে পুরুষদের মত মহিলাদেরও সম্পূর্ণ আইনগত ও রাজনীতিক সাম্য প্রদানের কথা বলা হয়। মিলের মতানুসারে যুক্তির ভিত্তিতে সমাজ সংগঠিত হওয়া দরকার। নারী-পুরুষের বিষয়টি হল জন্মগত বিষয়। সমাজ-সংগঠনের ক্ষেত্রে বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক। পুরুষদের মত মহিলাদেরও সকল অধিকার ও স্বাধীনতায় সমানাধিকার বর্তমান। বিশেষতঃ ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে বিষয়টি অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ।
বিংশ শতকের শেষদিক থেকেই ঐতিহাসিকেরা আলোচনা করে এসেছেন যে, নারীরা কীভাবে ফরাসি বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছিল এবং ফরাসি নারীদের ওপর বিপ্লবের কী দীর্ঘকালীন প্রভাব পড়েছিল। বিপ্লব-পূর্ববর্তী ফ্রান্সে নারীদের কোনো রাজনৈতিক অধিকার ছিল না, তাদেরকে নিষ্ক্রিয় নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হত এবং তারা নিজেদের ভালো-মন্দ বিচারের জন্য পুরুষদের ওপর নির্ভর হতে বাধ্য ছিল। তবে এইসময় নারীবাদ-এর প্রভূত অগ্রগতি পরিস্থিতিটির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটায়। প্যারিসে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের একটি অঙ্গ হিসেবে নারীবাদের উদ্ভব হয়েছিল। ফরাসি নারীরা প্রথমে পুরুষদের মতো সমান অধিকার এবং পরে পুরুষতন্ত্রের অবসানের জন্য আন্দোলন করে।এই আন্দোলনে তাদের প্রধান হাতিয়ার ছিল নানান ধরনের প্রচারপত্র ও বিভিন্ন নারী সংগঠন, যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্ল্যেখযোগ্য ছিল বিপ্লবী প্রজাতান্ত্রিক নারীদের সংঘ (Society of Revolutionary Republican Women)। তবে ১৭৯৩-এর অক্টোবরে শাসকদল জ্যাকোবিন (গোঁড়াপন্থী) সমস্ত ধরনের নারী সংগঠনের অবসান ঘটায় এবং তাদের নেত্রীদেরকে গ্রেপ্তার করে। এরফলে আন্দোলনের গতি রুদ্ধ হয়। ডেভান্স এই সিদ্ধান্তকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যুদ্ধকালে পুরুষতন্ত্রের প্রাধান্য, রাজকার্যে নারীদের হস্তক্ষেপ নিয়ে মারি আঁতোয়ানেতের কুখ্যাতি এবং চিরাচারিত পুরুষ আধিপত্যকে দায়ী করেছেন।
[১] এর এক দশক পরে নেপোলিয়নের আইনস্ংহিতা নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা প্রদান করে।
[2] বিপ্লব-পূর্ববর্তী ফ্রান্সে নারীদের কোনো রাজনৈতিক অধিকার ছিল না, তারা ভোট দিতে পারত না এবং সরকারের কোনো পদে থাকতে পারত না।তাদেরকে ‘নিষ্ক্রিয়’ নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হত এবং তারা নিজেদের ভালো-মন্দ বিচারের জন্য পুরুষদের ওপর নির্ভর হতে বাধ্য ছিল। আসলে পুরুষেরাই তাদের স্বার্থের জন্য নারীদের ক্ষেত্রে এই অসমতার সৃষ্টি করেছিল। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তারা পুরুষদের প্রাধান্য স্বীকার করতেও বাধ্য ছিল।
[৩]পঠনপাঠনের ক্ষেত্রেও নারীদেরকে একজন ভালো স্ত্রী ও মা হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হত। এর ফলে তারা কখনোই রাজনৈতিক চৌহদ্দির মধ্যে প্রবেশ করতে পারেনি। তাদের কর্মকাণ্ড শিশুদেরকে ভাবী নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতেই সীমাবদ্ধ ছিল।
[৪] প্রাক-বিপ্লব সমাজে নারীদের এই গৌণ ভূমিকাকে উল্লেখযোগ্যভাবে তুলে ধরা হয়েছে ১৭৫০ সালে প্রকাশিত ফ্রেডারিচিইয়ান কোড-এ। নারীদের এই ভূমিকার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন জ্ঞানালোক (Enlightenment) আদর্শে বিশ্বাসী দার্শনিক ও তাদের রচনাসমূহ।
[৫]ভূমিকাকে উল্লেখযোগ্যভাবে তুলে ধরা হয়েছে ১৭৫০ সালে প্রকাশিত ফ্রেডারিচিইয়ান কোড-এ। নারীদের এই ভূমিকার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন জ্ঞানালোক (Enlightenment) আদর্শে বিশ্বাসী দার্শনিক ও তাদের রচনাসমূহ ।
১৭৫০-এর দশকের অত্যন্ত প্রভাবশালী বিশ্বকোষ জ্ঞানালোক-এর ধারণাকে পেশ করে এবং এর চিন্তাধারাই ফ্রান্সে পরবর্তীকালে বিপ্লবে ইন্ধন জুগিয়েছিল। ফরাসি পণ্ডিত লুই দে জোকুয়ো সমাজে নারীদের অবস্থান নিয়ে নানান প্রবন্ধ লিখে তাদের চিরাচরিত ভূমিকাকে তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে, “একজন স্বামীর আধিপত্য করার ক্ষমতা যে প্রকৃতি-প্রদত্ত, তার প্রমাণ দেওয়া একদিকে যেমন যথেষ্ট কঠিন; ঠিক তেমনই এই ধারণাটি মানব সমতার পরিপন্থী… একজন পুরুষ সর্বদাই একজন নারী অপেক্ষা শারীরিক, মানসিক, বৌদ্ধিক কিংবা আচরণগত দিক থেকে অধিক শক্তিশালী হতে পারে না…ইংল্যান্ড এবং রাশিয়ার ঘটনা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে, নারীরা মধ্যপন্থী এবং স্বৈরাচারী উভয় শাসনতন্ত্রেই সফলতার সাথে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে…।” নারীর ভূমিকার এই বিপ্লবী ও প্রজাতান্ত্রিক রূপান্তরের পূর্বাভাস পাওয়া যায় জঁ-জাক রুসোর বিখ্যাত শিক্ষামূলক গ্রন্থ এমিলি-তে (১৭৬২), এইসময় বহু সংস্কারমুক্ত মানুষ নারীর ভোটাধিকার-সহ তাদের সমানাধিকারকে সমর্থন জানায়। এক্ষেত্রে নিকোলা দ্য কুঁদোরসে তার সমর্থনকার্যের জন্য বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখেন। তিনি নারীদের সমানাধিকারের সমর্থনে Journal