একটি শৃঙ্খলা হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিবর্তন–
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (IR) একটি একাধিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে বিকশিত একটি শৃঙ্খলা, যা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সংঘটিত সম্পর্কের অধ্যয়ন করে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই শৃঙ্খলা ইতিহাসের নানা দৃষ্টিতে বিবর্তিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শুরুর দিক:
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শৃঙ্খলার সূচনা ১৯০০-এর দশকে, বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। ঐ সময়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান (Political Science) ও ইতিহাসের সংমিশ্রণ থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্ম হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রথম দিকের গবেষণা ছিল মূলত রাষ্ট্রের বৈশ্বিক ক্ষমতা, যুদ্ধ, শান্তি, কূটনীতি, এবং রাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য সম্পর্কিত বিষয়গুলোর উপর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যুগ:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শৃঙ্খলার বিকাশ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এই সময়ের মধ্যে ‘কোল্ড ওয়ার’ (Cold War), ‘নিউক্লিয়ার থিওরি’, এবং বৈশ্বিক সংস্থাগুলির প্রতিষ্ঠা (যেমন জাতিসংঘ, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শৃঙ্খলাকে ত্বরান্বিত করেছে। সেই সাথে মার্কসবাদী, বাস্তববাদী, মুক্তবাজারবাদী এবং প্রতিষ্ঠাতা থিওরি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রধান শৈলী হিসেবে উঠে আসে।
আধুনিক যুগ:
আধুনিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বর্তমানে ঐতিহ্যগত রাষ্ট্রকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গি এবং অধ্যয়ন ক্ষেত্র নিয়ে বিকশিত হয়েছে। নতুন দৃষ্টিকোণ যেমন ‘লিঙ্গ’, ‘পরিবেশ’, ‘মানবাধিকার’, ‘অর্থনীতি’, এবং ‘সামাজিক ন্যায়’ ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যয়নে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আন্তঃবিষয়ক অধ্যয়নের প্রবণতা এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপগ্রহ হওয়া
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যয়ন একে একে বিভিন্ন শৃঙ্খলা থেকে প্রভাবিত হয়েছে, বিশেষ করে অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস, এবং দর্শন। এই ‘আন্তঃবিষয়ক’ প্রবণতা আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে একটি বৃহত্তর ও আরও বিবিধ শৃঙ্খলা হিসেবে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ের সমন্বয় ঘটেছে। এতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শৃঙ্খলাটি বিশাল পরিসরে সম্প্রসারিত হয়েছে, তবে একইসঙ্গে কিছু সমালোচনা রয়েছে যে এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপশাখায় পরিণত হতে পারে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপগ্রহ হওয়ার সমালোচনা:
কিছু ঐতিহ্যবাহী দৃষ্টিভঙ্গির মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শৃঙ্খলা যদি শুধুমাত্র রাষ্ট্র ও তার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে, তবে এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি উপগ্রহের মতো কাজ করতে পারে। কিন্তু, আন্তঃবিষয়ক অধ্যয়নের প্রবণতা এই তর্কের বিরোধিতা করে। কারণ এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সাথে অন্যান্য শৃঙ্খলার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে একে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ও গভীর করেছে।
যদিও রাষ্ট্রবিজ্ঞান ঐতিহ্যগতভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল শৃঙ্খলা হিসেবে গণ্য হলেও, আধুনিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শৃঙ্খলা একটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকেও বিশ্বব্যাপী সম্পর্কের বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘পরিবেশবিদ্যা’ বা ‘মানবাধিকার’ এর মতো ক্ষেত্রগুলি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যয়নে প্রবেশ করে একে সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, এবং অন্যান্য সামাজিক শৃঙ্খলার দিকে বিস্তৃত করেছে।
আন্তঃবিষয়ক’ প্রবণতার ইতিবাচক দিক:
- বৈশ্বিক সমস্যা সমাধান: বিভিন্ন শৃঙ্খলা একত্রে কাজ করতে সক্ষম হয়েছে, যেমন পরিবেশ, অর্থনীতি, মানবাধিকার ইত্যাদি, যা বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে সাহায্য করেছে।
- বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি: আধুনিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শুধুমাত্র রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক নয়, বরং আন্তর্জাতিক সমাজের অবস্থা, পরিবেশ, সাংস্কৃতিক বিষয়াদি, মানবাধিকার ইত্যাদিকেও গুরুত্ব দেয়, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরো ব্যাপক ও বিশ্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে সাহায্য করেছে।
- জটিলতা ও আন্তঃসম্পর্ক: আধুনিক বিশ্বের সমস্যাগুলির মধ্যে একাধিক মাত্রা এবং সম্পর্ক রয়েছে, যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করা কঠিন। বিভিন্ন শৃঙ্খলার সমন্বয়ে সেই জটিলতা ভালভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে।
উপসংহার:
আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ‘আন্তঃবিষয়ক’ অধ্যয়ন প্রবণতা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপগ্রহ হওয়ার ধারণাকে সম্পূর্ণভাবে মেনে নেওয়া সঠিক নয়। বরং এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও বিস্তৃত, গভীর এবং বৃহত্তর দৃষ্টিতে দেখতে সাহায্য করেছে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র ও তার বাইরের অন্যান্য বিশ্বজনীন সমস্যার মধ্যে সংযোগ স্থাপন এবং সম্পর্কের নতুন দৃষ্টিকোণ তৈরি হয়েছে। তাই, আধুনিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিবর্তন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক উপশাখা হয়ে পড়ার বদলে একটি বিস্তৃত ও অনেক দিক থেকে সম্পর্কিত শৃঙ্খলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।