ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কয়েকটি উপন্যাসের পরিচয় দিয়ে বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে তাঁর অবদান আলোচনা করো

বাংলা উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান

সমস্যাজীর্ণ গ্রামীণ সমাজ এবং সাধারণ মধ্যবিত্ত ও বিত্তহীন মানুষের স্নেহ, প্রেম, সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশার কথা তার উপন্যাসে প্রকাশ করেছেন দরদি কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলিকে নিম্নলিখিত কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়-

পারিবারিক উপন্যাস: শরৎচন্দ্রের এই পর্যায়ের উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘মেজদিদি’, ‘নিষ্কৃতি’, ‘বৈকুণ্ঠের উইল’ ইত্যাদি। পারিবারিক দ্বন্দ্ব-জটিলতা, নারী মনস্তত্ত্ব, বিবিধ বৈষম্য এই উপন্যাগুলিতে স্থান পেয়েছে।

প্রেমমূলক উপন্যাস: ‘বড়দিদি’, ‘দেবদাস’, ‘পরিণীতা’, ‘দত্তা’, ‘দেনাপাওনা’ প্রভৃতি উপন্যাস হল শরৎচন্দ্রের কয়েকটি বিখ্যাত প্রেমমূলক উপন্যাস।

আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস: শরৎচন্দ্রের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের মধ্যে এক এবং অদ্বিতীয় হল ‘শ্রীকান্ত’।

রাজনৈতিক উপন্যাস: ‘পথের দাবী’ হল শরৎচন্দ্রের একটি বিখ্যাত রাজনৈতিক উপন্যাস। একদা নিষিদ্ধ ঘােষিত হওয়া এই উপন্যাসটিতে সহিংস বিপ্লব শ্রদ্ধার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে।

মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস: শরৎচন্দ্রের তিনটি শ্রেষ্ঠ মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস হল ‘গৃহদাহ’, ‘চরিত্রহীন’ ও ‘শেষ প্রশ্ন’।

সামাজিক উপন্যাস: ‘পল্লীসমাজ’ শরৎচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামাজিক উপন্যাস। এই উপন্যাসে কথাশিল্পী গ্রাম্য সমাজপতিদের দলাদলি, হিংসা, স্বার্থপরতা, সম্পত্তির জন্য লােলুপতা ইত্যাদি তুলে ধরেছেন।

শরৎচন্দ্রের উপন্যাস শুধু বাঙালি পাঠক সমাজে নয়, অনুবাদের মাধ্যমে তা সমগ্র ভারতবর্ষে এবং ভারতবর্ষের বাইরেও পরিচিতি পেয়েছে।

শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য:

শরৎচন্দ্রের উপন্যাস-বৈশিষ্ট্য: বাংলা উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৭৬-১৯৩৮ খ্রি.) অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

  • দেশপ্রেম এবং অবহেলিত জনগণের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগই তাঁকে সাহিত্যসাধনায় অনুপ্রাণিত করেছিল।
  • বাঙালির দুঃখ-দারিদ্র্য ও মর্মবেদনাকে তিনি মূর্ত করে তুলেছেন চোখের জলে, প্রেমের মাধুর্যে এবং জীবনদর্শনের গভীরতায়।
  • তাঁর উপন্যাসে একদিকে যেমন নিষ্ঠুর হৃদয়হীনতাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, ঠিক তেমনি কখনাে কখনাে তিনি সামাজিক মূঢ়তা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, দেশপ্রেমের নামে ভণ্ডামির বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়ে উঠেছেন।
  • পল্লিবাংলায় দারিদ্র ও কুসংস্কারের ফাঁসিকাঠে বলিপ্রদত্ত ঠি বাঙালিজীবনের ছবি আঁকাই শরৎ-উপন্যাসের সবথেকে বড়াে বৈশিষ্ট্য।
  • নারীমনের জটিলতা, তাদের সংস্কার ও প্রেমের দ্বন্দ্ব, যৌথ পরিবারের দৈনন্দিন জীবনচিত্র এবং সেখানে নারীদের স্থান ইত্যাদি নানা চোখের-জলে-ভেজা বাস্তবসম্মত কাহিনি রূপায়ণে বাংলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্র নিঃসন্দেহে এক অদ্বিতীয় কথাশিল্পী।
  • গল্প বলার সহজ-সরল অথচ চিত্তাকর্ষক রীতির জন্য তিনি প্রথম থেকেই অভিজাত পরিবার থেকে শুরু করে গড়পড়তা মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত বাঙালি পরিবারে সমাদর লাভ করেছেন।

পরিশেষে বলা যায়, অভিজ্ঞতার গভীর ও বিপুল বিস্তারে, প্রখর পর্যবেক্ষণ-শক্তিতে, সংস্কারমুক্ত মন ও মননে, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণে, আবেগের উচ্ছ্বাসে এবং সংবেদনশীলতায় ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাসের জগতে অমর হয়ে আছেন।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading