কিভাবে বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তি কোরিয়ার উপর তাদের ক্ষমতা প্রসারিত করেছিল?

কিভাবে বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তি কোরিয়ার উপর তাদের ক্ষমতা প্রসারিত করেছিল?

ভূমিকা:

কোরিয়া, যা এক সময় চীনের প্রভাবাধীন একটি দেশ ছিল, ইউরোপীয় শক্তির আগ্রাসন এবং আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সময়ে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড হয়ে ওঠে। ১৯শ শতকের শেষের দিকে এবং ২০শ শতকের প্রথম দিকে, কোরিয়া ইস্ট এশিয়ার জটিল রাজনৈতিক দৃশ্যে একটি কৌশলগত অবস্থানে ছিল, যেখানে ইউরোপীয় শক্তির প্রতিযোগিতা ও আগ্রাসন প্রভাব ফেলেছিল। ইউরোপীয় শক্তির আগ্রাসন কেবল বাণিজ্যিক লাভের জন্য নয়, বরং কৌশলগত, সামরিক এবং অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যেও ছিল। এই সময় ইউরোপীয় দেশগুলো বিশেষভাবে কোরিয়ার উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে বিভিন্ন কূটনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল।

ইউরোপীয় শক্তির আগ্রাসনের পূর্বাভাস:

১৯শ শতকের প্রথম দিকে কোরিয়া ছিল একটি বন্দিদ্বীপ রাষ্ট্র, যা চীনের আধিপত্যাধীন ছিল। কোরিয়া চীনকে “বিশ্বস্ত” প্রতিবেশী হিসেবে বিবেচনা করত এবং এর বাইরের দেশগুলোর সাথে সীমিত সম্পর্ক রাখত। তবে, ইউরোপীয় শক্তির আগ্রাসন কোরিয়ার ওপর তাদের প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করেছিল। ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো কোরিয়ার বাজারে প্রবেশ করতে চেয়েছিল এবং তাদের পণ্যের জন্য নতুন বাজার খুঁজে পেতে চাইছিল।

১. বাণিজ্যিক আগ্রাসন:

ইউরোপীয় শক্তিগুলোর প্রথম পদক্ষেপ ছিল কোরিয়ায় বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন। ১৮৫৩ সালে, আমেরিকান কমোডর মেটিউ পেরি জাপানে তার বাণিজ্যিক নীতির কার্যক্রম শুরু করার পর, অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তি, বিশেষ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং রাশিয়া কোরিয়ায় বাণিজ্যিক প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ব্রিটেন এবং ফ্রান্স কোরিয়ার সাথে খোলামেলা বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে, যদিও কোরিয়া তাদের সাথে বিশেষ বাণিজ্যিক চুক্তি করতে অস্বীকার করেছিল। ইউরোপীয় শক্তির বাণিজ্যিক আগ্রাসন কোরিয়ার সীমিত অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছিল, যা দেশটির অর্থনীতিতে ইউরোপীয় পণ্য প্রবাহের সূচনা করেছিল।

২. সামরিক হস্তক্ষেপ এবং কূটনৈতিক পদক্ষেপ:

১৮৫৬-১৮৭৪ সালের মধ্যে, ইউরোপীয় শক্তি কোরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য চাপে ফেলেছিল। বিশেষত, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স কোরিয়ায় তাদের বাণিজ্যিক সুবিধা অর্জন করতে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেছিল। ১৮৬৬ সালে, ফ্রান্স কোরিয়ার বন্দিদের নির্বাসিত করার পর, ব্রিটেন কোরিয়ার সীমানায় সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিল। ১৮৭১ সালের “পালিসে হুর” হামলার সময়, ব্রিটেন কোরিয়ার বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভিযান চালায়, যার ফলে কোরিয়া এক ধরনের সামরিক চাপে পড়ে। এই সব ঘটনাগুলি কোরিয়া এবং ইউরোপীয় শক্তির মধ্যে সম্পর্কের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল, যেখানে কোরিয়া ইউরোপীয় শক্তির সামরিক এবং কূটনৈতিক হস্তক্ষেপের মুখোমুখি ছিল।

৩. চীনের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় শক্তির পদক্ষেপ:

চীন একদা কোরিয়ার শাসক রাষ্ট্র ছিল এবং কোরিয়া তার প্রভাবের মধ্যে ছিল। কিন্তু ইউরোপীয় শক্তির আগ্রাসন চীনের প্রতি কোরিয়ার সম্পর্কের উপর নতুন চাপ সৃষ্টি করেছিল। ১৮৭৬ সালে, প্রথম কোরিয়া-জাপান চুক্তির পর, জাপান কোরিয়া সম্পর্কে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে, যা পরবর্তীতে কোরিয়ার উপর ইউরোপীয় শক্তির এক ধরনের পরোক্ষ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ সৃষ্টি করে। এর মাধ্যমে, ইউরোপীয় শক্তির কোরিয়ার উপর শাসন বা প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে চীনের শক্তির উপর তাদের উপসর্গ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।

৪. রাশিয়ার আগ্রাসন:

রাশিয়া ১৮শ শতকের শেষভাগে কোরিয়ার প্রতি আগ্রহী হতে শুরু করে। রাশিয়া কোরিয়ার তীরে তাদের সামরিক শক্তি প্রভাবিত করার জন্য কাজ করছিল, বিশেষ করে কোরিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ এবং কৌশলগত অবস্থানকে লক্ষ্য করে। ১৮৯০-এর দশকে, রাশিয়া কোরিয়ার উত্তরাঞ্চলে একটি শক্তিশালী সামরিক উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করেছিল। এই অবস্থানে তাদের উদ্দেশ্য ছিল কোরিয়া এবং মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলে রাশিয়ার স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করা। রাশিয়া কোরিয়ার প্রতি তার আগ্রাসনকে এক প্রকার সমুদ্রপথের কৌশলগত উপকরণ হিসেবে দেখতে শুরু করেছিল। রাশিয়া এবং জাপান এই অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল, যা পরবর্তী রুশ-জাপান যুদ্ধের (১৯০৪-১৯০৫) অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

৫. ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের কূটনৈতিক পদক্ষেপ:

কোরিয়া যত বেশি ইউরোপীয় শক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স কূটনৈতিকভাবে কোরিয়া এবং জাপানের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিল। যদিও কোরিয়া সরাসরি ব্রিটেন বা ফ্রান্সের অধীন ছিল না, তাদের বাণিজ্যিক এবং কূটনৈতিক পদক্ষেপ কোরিয়ায় পশ্চিমি শক্তির প্রভাব বিস্তার করেছিল। ১৮৯৮ সালে ব্রিটেন কোরিয়ার সঙ্গে একটি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা কোরিয়ার অভ্যন্তরীণ নীতিতে ইউরোপীয় প্রভাব প্রতিষ্ঠার দিকে এক নতুন পদক্ষেপ ছিল।

৬. কোরিয়া জাপানির দখলে:

অবশেষে, ইউরোপীয় শক্তির কূটনৈতিক এবং সামরিক পদক্ষেপগুলি কোরিয়া এবং চীনের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ককে আরও জটিল করে তোলে। কোরিয়া, যেটি চীনের প্রভাবাধীন ছিল, সেই স্থানেই জাপান দ্রুত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৮৯৫ সালে শিমোনোসেকি চুক্তি এবং পরবর্তীতে ১৯১০ সালে কোরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে জাপানের দখলে চলে আসে। এই পদক্ষেপটি ছিল ইউরোপীয় শক্তির মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতার একটি ফলস্বরূপ, যেখানে জাপান কোরিয়াকে ইউরোপীয় শক্তির কাছে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছিল।

উপসংহার:

ইউরোপীয় শক্তিগুলি কোরিয়ায় তাদের ক্ষমতা প্রসারিত করার জন্য কূটনীতি, সামরিক অভিযান এবং বাণিজ্যিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। কোরিয়া, যা চীনের প্রভাবাধীন ছিল, ইউরোপীয় শক্তির আগ্রাসনের ফলে একটি জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কোরিয়ার জন্য এটি ছিল একটি সময় যখন পশ্চিমি শক্তিগুলি তাদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে চীনের শক্তির বিপরীতে কাজ করছিল, এবং এই সমস্ত পদক্ষেপ পরবর্তীতে জাপানকে কোরিয়ার উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ প্রদান করেছিল।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading