কোঠারি কমিশন বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার উদ্দেশ্য, শিক্ষার কাঠামো-
বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কমিশন যে সুপারিশ করেছেন সেগুলি হল- প্রাক-প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার উদ্দেশ্য:
কোঠারি কমিশন এর স্তরের শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য-
(i) শিশুদের সুস্থ স্বাস্থ্য অভ্যাস সহ নিজেদের adjustment-এর জন্য বিভিন্ন দক্ষতা। সৃষ্টি, যেমন-নিজের পোশাক পরার অভ্যাস, টয়লেটে যাওয়ার অভ্যাস, নিজে খাওয়ার অভ্যাস, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস সৃষ্টি ইত্যাদি।
(ii) সমাজ সম্বন্ধে আগ্রহ সৃষ্টি করা ও ব্যবহার শেখা; বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের অভ্যাস গঠন, নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতনতা ইত্যাদি গড়ে তোলাও এই স্তরের শিক্ষার উদ্দেশ্য।
(iii) শিশুদের মধ্যে প্রক্ষোভ জাগিয়ে তোলা।
(iv) তাদের প্রশংসার মনোভাব জাগিয়ে তোলা।
(v) তাদের মধ্যে সৃজনশীল ক্ষমতার বিকাশ ঘটানো।
(vi) শিশুদের মধ্যে চিন্তাশক্তি জাগিয়ে তোলা, শুদ্ধ ও স্পষ্ট বক্তব্য রাখতে শেখানো।
(vii) শিশুদের সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করে তোলা ও সাধারণ দক্ষতা (major skill) গড়ে তোলা ইত্যাদি।
কমিশনের মতে, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার উদ্দেশ্য:
(1) দায়িত্বশীল ও উপযুক্ত নাগরিক তৈরি করাই হল, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার উদ্দেশ্য।
(ii) 14 বছর বয়স পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা দেওয়ার জন্য যে ১৯২১ সাংবিধানিক নির্দেশ আছে তাকে কার্যকর করার জন্য কমিশন নিম্নলিখিত ব্যবস্থা কায়সার গ্রহণের কথা বলেছেন-
কমিশন দেখেছেন, প্রাথমিক স্তরে Class I-এ অনুত্তীর্ণতা সবচেয়ে বেশি। Class সমন্ধী II-এ এই অনুত্তীর্ণতা অনেকটা কম। Class III & Class IV-এ এই অনুত্তীর্ণতার সংখ্যা একই রকম থাকে এবং উচ্চপ্রাথমিক স্তরে আবার কমতে থাকে। আবার মতিন ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ক্ষেত্রে অনুত্তীর্ণতা সবথেকে বেশি। তবে অঞ্চলভেদে এই সংখ্যার পার্থক্যও ঘটতে পারে। অপচয়ের ক্ষেত্রেও প্রথম শ্রেণিতে এই সংখ্যা সিরিজে সবচেয়ে বেশি। উচ্চপ্রাথমিক স্তরে অপচয় অনেক কম।
শিক্ষার ক্ষেত্রে অপচয় ও অনুত্তীর্ণতা যাতে কম হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে যাতে প্রথম শ্রেণিতে ভরতি হওয়া ছাত্রসংখ্যার অন্তত 40 শতাংশ সাত বছরে সপ্তম শ্রেণিতে পৌঁছোয়।
(iii) নিছক জ্ঞানমূলক বিষয়ের পরিবর্তে বাস্তব জীবনের সহায়ক বিষয়কে পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
(iv) সপ্তম শ্রেণির শেষে কোনো শিক্ষার্থীর বয়স যদি 14 বছরের কম হয় এবং সে যদি আরও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চায় তবে তাকে 14 বছর বয়স পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যালয়ের কোনো বৃত্তিধর্মী কাজে নিযুক্ত রাখতে হবে।
(v) প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য সফল করতে হলে প্রয়োজন রাজ্য ও জেলাভিত্তিক একটি সুসমন্বিত পরিকাঠামো। লক্ষ রাখতে হবে অর্থের অভাবে প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার যেন ব্যাহত না হয়। Pre-registration ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।
(vi) পরবর্তী দশ বছরের প্রাথমিক শিক্ষায় গুণগত মান বাড়ানো প্রয়োজন।
(vii) 1975-76 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সকল শিশুকে। বছরের কার্যকারী প্রাথমিক শিক্ষা দিতে হবে।
কমিশনের মতে-শিক্ষার কাঠামো:
তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার কাঠামো, শিক্ষার স্থিতিকাল সম্পর্কে বিভিন্ন রাজ্যগুলির মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য ছিল না। সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল শিক্ষাস্তরের স্থিতিকাল বাড়ালেই শিক্ষার মান উন্নত হবে। এই কারণে মুদালিয়ার কমিশন শিক্ষা কাঠামোকে পুনর্বিন্যাস করেন এবং কয়েকটি স্তরের বিন্যাস করে নতুন শিক্ষা কাঠামোর একটি উল্লেখযোগ্য সুপারিশ করেন। সুপারিশগুলি হল-
(a) নার্সারি: 3-5 বছরের শিশুদের জন্য প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা অর্থাৎ এক থেকে তিন বছরের প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা। নার্সারি ও কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা হবে এই স্তরে। (b) প্রাক্-প্রাথমিক স্তর: 5-6 বছরের শিশুদের জন্য প্রাক্-প্রাথমিক শ্রেণি। (c) প্রাথমিক স্তর: প্রাথমিক শিক্ষান্তর হবে দুটি-
(i) নিম্নপ্রাথমিক: প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত (1 to IV) অথবা প্রথম থেকেপঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত (I to V) অর্থাৎ চার অথবা পাঁচ বছরের জন্য হবে নিম্নপ্রাথমিক শিক্ষাস্তর, শিক্ষার্থীদের বয়স হবে 6-11 বছর।
(ii) উচ্চপ্রাথমিক: পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত (V to VII) অথবা ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত (VI to VIII), শিক্ষার্থীদের বয়স হবে 11-14 বছর। Pre- registration (আগে থেকে নাম নথিভুক্তকরণ) প্রথা প্রাথমিক স্তরে চালু করা দরকার। প্রতিটি শিশুর বাড়ি থেকে। মাইলের মধ্যে নিম্নপ্রাথমিক বিদ্যালয়ও 1-3 মাইলের মধ্যে থাকবে উচ্চপ্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রাথমিক স্তরের পরের 2-3 বছরের বৃত্তি শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
পাঠক্রম বিভিন্ন স্তরের:
সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন। উন্নয়নের অন্যতম অপরিহার্য অঙ্গ হল শিক্ষার পাঠক্রমের পরিবর্তন। কমিশন মনে করেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থার পাঠক্রমের পরিবর্তন আসেনি। তাই কমিশন বলেন, গতানুগতিক অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলিকে বাদ দিয়ে নতুন প্রয়োজনীয় বিষয়গুলিকে সংযোজন করে পাঠক্রমের পরিবর্তন আনা বাঞ্ছনীয়। এই কারণে বিদ্যালয় শিক্ষার পাঠক্রমের পরিবর্তন প্রসঙ্গে কমিশনের সুপারিশগুলি হল-
(1) প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষাস্তর: কমিশনের প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত কমিটির মতামতকে ‘Committee on Child Care (1961-62)’ গুরুত্ব দেন। তাঁদের মতামতের উপর গুরুত্ব দিয়ে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি সুপারিশ করেন-
(i) খেলাধুলা-যার মধ্যে রয়েছে খেলার উপকরণ। বিভিন্ন Indoor এবং, Outdoor খেলার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যেখানে সব শিশু মুক্তভাবে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে পারবে।
(ii) শারীরিক ক্রিয়াকলাপ।
(iii) শারীরশিক্ষা-যার মধ্যে রয়েছে সাধারণ ব্যায়াম, নাচ ইত্যাদি।
(iv) মানসিক শিক্ষা-যার মধ্যে রয়েছে বাগান তৈরি, বিভিন্ন সামাজিক সহজ কাজে অংশগ্রহণ ইত্যাদি।
(v) প্রাকৃতিক বস্তু ও বিশেষভাবে তৈরি জিনিসপত্র দিয়ে শিক্ষা।
(vi) বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ, আঙুলের দক্ষতা বাড়ে এমন ধরনের কাজ ইত্যাদি। এই কারণে অঙ্কন, পেন্টিং, গান প্রভৃতির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
(vii) শিখনমূলক কাজের মধ্যে রয়েছে ভাষা, স্বাস্থ্যসম্মত নিয়ম, প্রাথমিক প্রকৃতি সম্বন্ধে ধারণা (অর্থাৎ প্রকৃতিতে আশ্রিত বিভিন্ন জীবন, জীবজন্ত সম্বন্ধে ধারণা)। (viii) গণনা শেখা ও পাটিগণিত শেখার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
(ix) স্কুলের জীবনযাত্রায় নিজের কাজ নিজে করার ইচ্ছা (বড়োদের সাহায্য নিয়ে)।
তবে শিশুদের উপযুক্ত সুযোগ দেওয়া হয় না। তাদের দিনের বেলায় খাবার ব্যবস্থা (mid-day meal) করা বাঞ্ছনীয়। শিশুশিক্ষা যাতে অবহেলিত না হয় সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে শিক্ষকদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।
(2) নিম্নপ্রাথমিক শিক্ষাস্তর (I-IV or V):
(a) একটি ভাষা-মাতৃভাষা অথবা একটি আঞ্চলিক ভাষা।
(b) গণিতের উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে যাতে শিশুদের মধ্যে শিখনের প্রাথমিক ধারণার (basic tools) বিকাশসাধন করা যায়।
(c) পরিবেশ সম্বন্ধে ধারণা-III & IV-এর ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান ছোতে মানায় পাঠের ব্যবস্থা থাকা দরকার, তবে এই বিষয়গুলিতে প্রাথমিক ধারণা দিতে হবে। IV-এর শিক্ষার্থীদের Roman alphabet শিক্ষা দিতে হবে। এ ছাড়া ম্যাপ, চাট ও রাশিবিজ্ঞানের টেবিল ব্যবস্থা শেখানো দরকার।
(d) সৃজনশীল কাজ-সংগীত, কলা, নাটক ও বিভিন্ন হাতের কাজ করতে হবে ১১ শিশুদের নিজেদের সৃষ্টিশীলতা প্রকাশের জন্য।
(e) কর্মশিক্ষা ও সমাজসেবা-কাগজ কাটা, কার্ডবোর্ড কাটা ও ভাঁজ করা, মাটি বা প্লাস্টিসিন দিয়ে মডেল তৈরি, সুতো কাটার কাজ, ছুঁচের কাজ, রান্নার কাজ, বাগান তৈরি ইত্যাদি। এই স্তরে সমাজসেবামূলক কাজের মধ্যে পড়ে ক্লাসঘর পরিষ্কার, স্কুল সাজানো ইত্যাদি।
(1) স্বাস্থ্য শিক্ষা-এই স্তরে শিশুদের ভালো স্বাস্থ্য অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা দেওয়া দরকার।
(3) উচ্চপ্রাথমিক স্তর (V-VII or VIII):
(a) দুটি ভাষা হবে আবশ্যিক –
(1) মাতৃভাষা অথবা আঞ্চলিক ভাষা।
(ii) হিন্দি অথবা ইংরেজি। এ ছাড়া একজন শিক্ষার্থী ইংরেজি, হিন্দি, আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে যে-কোনো একটি ভাষাকে তৃতীয় ঐচ্ছিক ভাষা হিসাবে নিতে পারে। (b) গণিত – প্রাথমিক স্তরে গণিতের মধ্যে পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতি পড়তে হবে। গণিতে বিভিন্ন সূত্র, গাণিতিক নীতি ও যুক্তিমূলক চিন্তনের উপর গুরুত্ব
দিতে হবে। পাঠ্যসূচিতে থাকবে development of number system, বিভিন্ন চিহ্ন, সমীকরণ, গ্রাফ ও function সম্বন্ধে ধারণা।
(c) বিজ্ঞান – (b) ও (c)-এই দুটি ক্ষেত্রে আগের তুলনায় আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
V শ্রেণির পাঠক্রমে থাকবে- পদার্থবিদ্যা, ভূবিদ্যা, জীবনবিজ্ঞান।
VI শ্রেণির পাঠক্রমে থাকবে- পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীবনবিজ্ঞান
VII শ্রেণির পাঠক্রমে থাকবে- পদার্থবিদ্যা, জীবনবিজ্ঞান, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা।
(d) সমাজবিজ্ঞান – এই স্তরে সমাজবিজ্ঞানের পাঠক্রমে থাকবে ইতিহাস, ভূগোল ও পৌরবিজ্ঞান।
(e) চারুকলা – এই স্তরে বিভিন্ন সৃজন ও উৎপাদনমূলক কাজের প্রাথমিক ধারণা থাকবে।
(1) কর্মশিক্ষা ও সমাজসেবা কর্মশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হলে কৃষি খামার, workshop ও অন্য উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। এই স্তরে কর্মশিক্ষার মধ্যে
রয়েছে বাঁশের কাজ, চামড়ার কাজ, মাটির কাজ, ছুঁচের কাজ, সেলাই, বাগান তৈরি, মডেল তৈরি, কৃষি খামারে কাজ ইত্যাদি। সমাজসেবামূলক কাজ প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবস্থা রাখতে হবে।
(g) শারীরশিক্ষা – এই স্তরের প্রথম দিকে ছেলে ও মেয়েদের অভিন্ন শারীরশিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। শেষ ১ বছরের শিক্ষার্থীদের রুচি ও আগ্রহ অনুযায়ী খেলাধুলার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে কম পরিশ্রমযুক্ত খেলা, যেমন-ব্যাডমিন্টন, থ্রো বল ইত্যাদি খেলার ব্যবস্থা রাখা দরকার। বাস্কেট বল, নেট বল, হকি এই স্তরে রাখতে হবে। Athletic item-এর এই স্তরে ব্যবস্থা রাখা দরকার।
(h) নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা সপ্তাহে একটি অথবা দুটি পিরিয়ড এই বিষয়ের শিক্ষার জন্য Time table-এর ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রাথমিক স্তরে বিভিন্ন নীতিগল্প বিধেয়, বিভিন্ন ধর্মের নীতিশিক্ষা দিতে হবে