গুপ্ত যুগের বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা করো

ভূমিকা : প্রাচীন ভারতে ‘সুবর্নযুগ‘ হিসাবে খ্যাত গুপ্ত যুগে একদিকে যেমন সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছিল অন্যদিকে তেমনই বিজ্ঞানচর্চারও প্রভুত উন্নতি হয়েছিল। জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, চিকিৎসা বিজ্ঞান, ভেষজ শাস্ত্র, রসায়ন, খনি ধাতুবিদ্যা প্রভৃতি বিজ্ঞানের নানা শাখার উন্নতি এই সময় লক্ষ্য করা যায়। গুপ্তযুগে বিজ্ঞানের এই অভূতপূর্ব অগ্রগতি সম্ভব হয়েছিল গুপ্ত রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ও তাদের আনুকূল্যে। গুপ্ত যুগের বিজ্ঞান চর্চার যেসব অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় সেগুলি নিন্মে তুলে ধরা হল

জ্যোতির্বিদ্যা  ঃ

গুপ্ত যুগে জ্যোতির্বিদ্যার উন্নতি সর্বাধিক লক্ষ্য করা যায়। আর্যভট্ট, বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত প্রমুখ ছিলেন গুপ্তযুগের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিদ। এছাড়াও বরাহমিহিরের রচনা থেকে লাট, সিংহ, প্রদ্যুন্ম, বিজয়নন্দিন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য জ্যোতির্বিদের কথা জানা যায়। গুপ্ত যুগে রচিত জ্যোতির্বিদ সংক্রান্ত গ্রন্থ গুলিকে ‘সিদ্ধান্তগ্রন্থ‘ বলে অভিহিত করা হত।

এই সময় বিহারের পাটলিপুত্রে জ্যোতির্বিদ আর্যভট্টের জন্ম হয়, যিনি ‘গুপ্ত যুগের নিউটন’ নামে খ্যাত। সূর্যসিদ্ধান্ত, আর্যভট্টিয়ম্, দশগীতিকাসূত্র, আর্যাষ্টশত প্রভৃতি হল আর্যভট্টের লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। আর্যভট্টিয়ম্ নামক গ্রন্থে তিনি পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি ও ত্রিকোণমিতির প্রয়োগ করেন, সূর্যসিদ্ধান্ত নামক গ্রন্থ থেকে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের কারণ জানা যায়। এছাড়া পৃথিবীর আকৃতি, আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও আর্যভট্টের অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে।

     গুপ্তযুগে আর্যভট্টের পরবর্তী উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ ছিলেন বরাহমিহির। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য দুটি গ্রন্থ হল বৃহৎ-সংহিতা পঞ্চসিদ্ধান্তিকা। বৃহৎ-সংহিতায় তিনি ভূমিকম্প, ঝড়-বৃষ্টি, বজ্রপাত, বিবাহ, ধুমকেতু, রাশিচক্র ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাখ্যা করেছেন।

গুপ্তযুগের অপর এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী ব্রহ্মগুপ্ত রচনা করেছেন ব্রহ্মস্ফুটসিদ্ধান্ত, ধ্যানগ্রন্থ, খণ্ডখাদ্য নামক গ্রন্থ। ব্রহ্মগুপ্তই ছিলেন প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞানী যিনি মাধ্যাকর্ষণ বিষয়ে আলোকপাত করেছিলেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহের স্থান নির্ণয়, সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য লিপিবদ্ধ করেছেন।

গণিতশাস্ত্র  ঃজ্যোতির্বিজ্ঞানের পাশাপাশিগুপ্ত যুগে গণিতেরও প্রভুত উন্নতি ঘটেছিল।১ থেকে ৯ পর্যন্ত সংখ্যার আবিষ্কার গুপ্তযুগেই হয়েছিল এবং শূন্যের ব্যবহারও গুপ্তযুগ থেকেই শুরু হয়। গুপ্তযুগে সংখ্যা গণনাপ্রণালীর কাজ প্রথম শুরু করেন আর্যভট্ট। তিনি তাঁর আর্যভট্টিয়ম্ গ্রন্থে পাটিগণিত, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি ও জ্যামিতির ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। গণিতের বহু জটিল বিষয়ের ব্যাখ্যা ব্রহ্মগুপ্ত তার লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। 

ধাতুবিদ্যা ঃ গুপ্ত যুগে জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতশাস্ত্রের মতো ধাতু বিদ্যারও অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। অমরকোষ গ্রন্থ থেকে সোনা, রূপো, তামা, লোহা প্রভৃতি ধাতুর ব্যবহার সম্পর্কে জানা যায়। বরাহমিহিরের বৃহৎ-সংহিতা গ্রন্থে ধাতুবিদ্যা বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। গুপ্ত যুগে রসায়নবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধাতুকে গলানো হত ও মিশ্র ধাতু তৈরি করা হত। এই সময় সোনা ও রুপার তৈরি মুদ্রা এবং মিশ্র ধাতু দিয়ে বিভিন্ন ধরণের মূর্তি তৈরি করা হত।

উপসংহারঃ  গুপ্ত যুগে জ্যোতির্বিদ্যা, গণিতশাস্ত্র ও ধাতুবিদ্যার মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞান চর্চার নানা দিক উন্মোচিত হয়েছিল। গুপ্ত যুগে আবিষ্কৃত সংখ্যাগণনাপ্রণালী হিসাবের ক্ষেত্রে অনেক সুবিধাপ্রদান করেছে। চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের কারণ আবিষ্কারের মাধ্যমেই আমরা বুঝতে পারি গুপ্তযুগে মানুষের চিন্তাশক্তি কতটা শক্তিশালী ছিল। তবে গুপ্তযুগকে সুবর্ণযুগের খ্যাতি এনে দেওয়ার পিছনে এযুগের বিজ্ঞানচর্চার অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে সেবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading