গুপ্ত সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো

ভূমিকা :- ইতিহাসের ধারা প্রবহমান হলেও, কতকগুলি কার্যকারণের জন্য তাতে পরিবর্তনের স্রোত দেখা যায়।মোর্যসম্রাজ্য পতনের পর ভারতে -এর রাজনীতিতে যে বিচ্ছিন্নতা, আঞ্চলিকতার প্রকাশ ও বৈদেশিক শক্তিগুলির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল তাতে ছেদ পড়ে এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যের উদ্ভব ঘটে।

উপাদান

  • গুপ্ত শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে গুপ্ত শিলালিপিগুলি, বিশেষত দামোদরপুর লিপি, বসরা সীল লিপি, বিভিন্ন ভূমিপট্টলী, ফা-হিয়েনের বিবরণ প্রভৃতি থেকে বহু তথ্য পাওয়া যায়। গুপ্তযুগে রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে কামন্দকের নীতিসার, স্মৃতিশাস্ত্রগুলি যথা, নারদ, যাজ্ঞ্যবল্ক স্মৃতি প্রভৃতি এবং মনুস্মৃতি বিশেষভাবে সাহায্য করে।
  • কিন্তু রাষ্ট্রনীতির এই গ্রন্থগুলিতে তাত্ত্বিক আলোচনা বিশদভাবে করা হলেও গুপ্ত শাসনের বাস্তব বিবরণ তেমন আলোচনা করা হয়নি। এজন্য এই গ্রন্থগুলি গুপ্ত শাসনের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না।

রাজার ক্ষমতা

 গুপ্ত শাসন ব্যবস্থায় আপাত দৃষ্টিতে রাজা ছিলেন সকল ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল। সেনাদল, কর্মচারীবৃন্দ তাঁরই নির্দেশে চলত। তিনি তাদের নিয়োগ করতেন এবং তাদের আনুগত্য ভোগ করতেন। রাজ্য শাসনের কাজে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাজাকে নিতে হত।

কেন্দ্রীয় প্রশাসন

  •   কেন্দ্রে রাজাকে শাসনের কাজে সাহায্যের জন্য মন্ত্রী, যুবরাজ ও উচ্চ কর্মচারীরা ছিল। গুপ্ত যুগে মন্ত্রীরা এককভাবে রাজাকে পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় সাহায্য দিত। কিন্তু মৌর্য যুগের মত কোনো মন্ত্রী পরিষদ গুপ্ত যুগে ছিল না।
  • কারও কারও মতে, মনুসংহিতায় মন্ত্রী পরিষদের আভাষ পাওয়া যায়। কিন্তু বেশীর ভাগ পণ্ডিত এমত অগ্রাহ্য করেন। কারণ, গুপ্ত যুগের কোনো শিলালিপিতে মন্ত্রী পরিষদের উল্লেখ নেই। মন্ত্রী পদ এই যুগে বংশানুক্রমিক ছিল।
  • উদয়গিরি গুহালিপি থেকে জানা যায় যে, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী বীর সেনের পিতাও মন্ত্রী ছিলেন। তিনি নিজেকে “অন্বয় প্রাপ্ত সচিব্য” বলেছেন। সন্ধি বিগ্রাহিক হরিসেনের পিতা ধ্রুবভূতিও মন্ত্রী ছিলেন। পশ্চিম ও মধ্য ভারতে গোপ্তৃ পদও বংশানুক্রমিক ছিল বলে জানা যায়। কখনও কখনও একই মন্ত্রী একাধিক পদ অধিকার করতেন।

কেন্দ্রীয় কর্মচারী

  • গুপ্ত সম্রাটরা কেন্দ্রে বহু কর্মচারী নিয়োগ করতেন। মহাবলাধিকৃত ছিলেন সেনাপ্রধান। তার অধীনে বিভিন্ন সামরিক পদ যথা, অশ্ব বাহিনীর প্রধান বা মহাশ্বপতি, হস্তীবাহিনীর প্রধান মহাপীলুপতি প্রভৃতি থাকত। মহাদণ্ডনায়ক সম্ভবত প্রধান সেনাপতি বা রক্ষী বাহিনীর প্রধান ছিলেন। তাঁর অধীনে অন্যান্য রক্ষীরা কাজ করত।
  • মহাপ্রতীহার ছিলেন রাজপ্রাসাদের রক্ষী বাহিনীর প্রধান। সন্ধি-বিগ্রহিক নামে একটি নতুন পদের কথা জানা যায়। এই কর্মচারী রাজাকে বৈদেশিক ব্যাপার, যুদ্ধ, সন্ধি প্রভৃতির বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। হরিষেণ ছিলেন সমুদ্রগুপ্তের সন্ধি-বিগ্রাহিক।
  • অক্ষ-পটলাধিকৃত নামে কর্মচারী সরকারী দলিলপত্র রচনা ও রক্ষা করতেন। এঁদের নীচে আরও নিম্নবর্গের কর্মচারী ছিল। যথা – করণিক বা কেরাণী, দৌবারিক বা দরওয়ান প্রভৃতি।

গুপ্ত সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করে শাসন করা হত। যেমন – (১) ভুক্তি এযুগে প্রদেশগুলির নাম ছিল দেশ বা ভুক্তি অথবা ভোগ। সাধারণত গাঙ্গেয় উপত্যকার প্রদেশগুলিকে ভূক্তি বলা হত। যথা – তীরভুক্তি বা ত্রিহুত, পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তি,ভূক্তি, অহিচ্ছত্রভুক্তি।

(২) দেশ

দেশ নামধারী অঞ্চল ছিল পশ্চিম ভারতে যথা, সৌরাষ্ট্র দেশ, সুকুলি দেশ। গোপ্তৃ উপাধিধারী কর্মচারীরা দেশ শাসন করত।

(৩) জেলা বা বিষয়

ভূক্তিগুলিকে জেলা বা বিষয়ে ভাগ করা হত। গুপ্ত প্রাদেশিক শাসনে বিষয় ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এরকম অনেকগুলি বিষয় বা জেলার নাম জানা যায়, যথা কোটিবর্ষ বিষয় বা দিনাজপুর জেলা, অন্তর্বেদী বিষয় বা দোয়াব জেলা প্রভৃতি। বিষয়ের শাসনের জন্য কুমারমাত্য, বিষয়াপতি, আযুক্ত প্রভৃতি কর্মচারীরা নিযুক্ত হত।

ভূক্তির শাসকের উপাধি ছিল উপারিক। কখনও কখনও রাজপরিবারের লোকেরা উপারিকের পদে কাজ করত। দামোদরপুর লিপি থেকে পুণ্ড্রবর্ধনের উপারিক মহারাজপুত্র দেবভট্টারকের নাম শোনা যায়।

বিষয়ের শাসনকর্তা সাধারণত প্রাদেশিক শাসনকর্তার দ্বারাই নিযুক্ত হত। তবে ইন্দোর লিপি থেকে জানা যায় যে, কখনও কখনও সম্রাট সরাসরি বিষয়ের শাসককে নিযুক্ত করতেন। অন্তর্বেদী বা দোয়াব বিষয়ের শাসনকর্তা সর্বনাগ ছিলেন সম্রাটের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে।

দামোদরপুর লিপি থেকে জানা যায় যে, সাধারণত উপারিকরাই বিষয়পতিদের নিয়ন্ত্রণ করত। আযুক্ত ও কুমারমাত্যরা বিষয়ের শাসনে নিযুক্ত থাকলেও তারা কেন্দ্রের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করত। বিষয়পতিরা নগর পরিষদের সাহায্যে রাষ্ট্রীয় জমি বিক্রি করত।

গ্রামীণ শাসন

গুপ্ত যুগে গ্রামের শাসন ব্যবস্থায় গ্রামিকরা সরকারী কর্মচারী হিসেবে কাজ করত। গ্রামের প্রধান বা মোড়লকে বলা হত মহত্তর বা ভোজক। এই ব্যক্তি গ্রাম শাসনে গ্রামিককে সাহায্য করত। গ্রামসভা বা মহাসভার সাহায্যে গ্রমিকরা পতিত জমি, কর্ষিত জমির আলাদা তালিকা করত, জমি মাপ করত, পথ ঘাট, বাজার, মন্দির, পুস্করিণী প্রভৃতি পরিচালনার ব্যবস্থা করত।

গ্রামীণ বিচার ব্যবস্থা

  • (১) গুপ্ত বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায় যে, গ্রামসভাগুলি প্রধানত গ্রামের বিচারের নিষ্পত্তি করত। বিষয় ও প্রাদেশিক শহরে সরকারী আদালত ছিল। এই আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রাজার কাছে আপীল করা যেত। ফা-হিয়েন গুপ্ত ফৌজদারী আইনের উদারতার কথা বলেছেন।
  • (২) রাজদ্রোহ ছাড়া অন্য অপরাধে অঙ্গচ্ছেদ করা হত না। লোকে সরকারী নিয়ন্ত্রণ-মুক্ত হয়ে স্বাধীন জীবন যাপন করত। রাষ্ট্রের খরচায় রাস্তাঘাট, পুল, বাঁধ ইত্যাদি তৈরি করা হত। লোকে যাতে ন্যায় পথে চলে এটা দেখবার জন্য বিনয় স্থিতিস্থাপক নামে কর্মচারীরা চেষ্টা চালাত।

গ্রামীণ রাজস্ব নীতি

  • (১) জমির ফসল থেকে রাজা বা ভাগ রাজস্ব পেতেন। এর নাম ছিল “ভাগ”।
  • (২) কর্মচারীদের বেতনের ওপর কর ধার্য করা হত। এই করের নাম ছিল ভোগ।
  • (৩) শুল্ক অর্থাৎ বাণিজ্য ও শিল্প দ্রব্য হতে প্রত্যয় বা আবগারী কর আদায় করা হত।

উপসংহার: মৌর্য সম্রাটদের মত গুপ্তচরদের দ্বারা খবর যোগাড় করতে হত না। শাসন ব্যবস্থা উদারপন্থী হওয়ার ফলে লোকে স্বাধীনতা ও স্বচ্ছন্দতার মধ্যে দিন কাটাত। তাদের দৈনন্দিন জীবনে সরকার হস্তক্ষেপ করত না। বিশেষভাবে কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণের মধ্যে সমন্বয় করা হয়েছিল। গুপ্ত শাসন ব্যবস্থার দুর্বল দিক ছিল যে, বিকেন্দ্রীকরণের ফলে আঞ্চলিকতা ও বিচ্ছিন্নতা প্রবল হতে থাকে। গুপ্ত কর্মচারীদের জমি দেওয়ার ফলে সামন্ত প্রথার প্রবলতা বাড়ে। ক্রমে সামন্তরা শক্তিশালী হয়ে স্বাধিকার-প্রমত্ত হয়ে ওঠে। গুপ্তযুগে নগর অপেক্ষা গ্রাম ও বিষয়গুলি প্রাধান্য পায়। প্রাচীন নগরগুলি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading