গৌড়ের নগর সমাজ সম্পর্কে আলোচনা করো। (Discuss about the urban society of Gour.)

সমসাময়িক সাহিত্য ও লেখমালায় পুণ্ড্রনগর, তাম্রলিপি, পঞ্চনগরী, বর্ধমান, কর্ণসুবর্ণ, কর্মান্ত-বসাক, চম্পা, বর্ধমানপুর, রামাবতী, বিজয়পুর, লক্ষণাবর্তী প্রভৃতি নগরীর উল্লেখ পাওয়া যায়। গ্রামপ্রধান প্রাচীন গৌড় বঙ্গে স্বভাবতই নগরের সংখ্যা স্বল্প। প্রতিটি নগরের পশ্চাদ্ভূমিতে ছিল বহুসংখ্যক গ্রাম। প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল নগর, তীর্থক্ষেত্রগুলিও ছিল নগর, আবার বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেও নগরী গড়ে উঠত। যে-কোনো কারণ বা কোনো উপলক্ষ্য করে নগর গড়ে উঠলেও তার বৈশিষ্ট্য ছিল দুটি-শিল্প-বাণিজ্যভিত্তিক অর্থনীতি এবং ঘন জনবসতি। গ্রামের তুলনায় নগরের অনেক বেশি সমৃদ্ধি এবং বিলাস-ব্যসনের উপকরণ। তার ইঙ্গিত আছে বিজয়সেনের দেওপাড়া প্রশস্তিতে। রামাবতী নগরীর ঐশ্বর্যের বর্ণনা আছে সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’-এ এবং পুণ্ড্রবর্ধন নগরীর সমৃদ্ধির উল্লেখ পাওয়া যায় কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’তে।

নগর সমাজে জাতি ও শ্রেণিবিন্যাস স্বতন্ত্রভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ গ্রাম- সমাজের সঙ্গে তার পার্থক্য স্পষ্ট বিদ্যমান ছিল। নগর-সমাজে প্রাধান্য অর্জন করেছিলেন বিত্তবান ব্রাহ্মণ, রাষ্ট্রপ্রধান, রাজ্যপাদোপজীবীদের মধ্যে ঊর্ধ্বতন সরকারি আমলাদের নিয়ে গঠিত অভিজাত শ্রেণি এবং শিল্পী-বণিক শ্রেষ্ঠীদের নিয়ে গঠিত ধনিক শ্রেণি।

বিত্তবান ব্রাহ্মণেরা অনেক সময় রাজসভা অলংকৃত করতেন বিদ্বান পণ্ডিত মন্ত্রীরূপে। তাঁরা যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করে রাজার কাছ থেকে প্রভৃত পরিমাণ অর্থ ও শস্যশালিনী ভূমি লাভ করতেন। রাষ্ট্র প্রধানদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন স্বয়ং মহারাজা, মহাসামন্ত, সামন্ত, মহামাগুলিক-মান্ডলিক প্রমুখ। রাজপাদোপজীবীদের মধ্যে উচ্চপদস্থ রাষ্ট্রীয় ও সামরিক কর্মচারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপরিক, বিষয়পতি, মন্ত্রী, মহামন্ত্রী, অমাত্য, সান্ধিবিগ্রহিক, দণ্ডনায়ক, মহাদওনায়ক, কুমারামাত্য, মহাপ্রতীহার, মহাসেনাপতি। প্রমুখ। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের পূর্ববর্তী বঙ্গদেশীয় লেখমালায় শ্রেষ্ঠী, সার্থবাহ, কুলিক (শিল্পী) প্রমুখের উল্লেখ স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় না। কিন্তু দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীর রচনা বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে উল্লেখিত কর্মকার, কাংস্যকার, শাঙ্খিক, শঙ্খকার, মালাকার স্বর্ণকার, তক্ষণ-সূত্রধর, শৌস্তিক, কুবিন্দক, তন্তুবায়দের শিল্পী গোষ্ঠীর বসবাস গ্রামের। মতো নগরেও ছিল। অট্টালিকার কোটক, সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিক প্রমুখ ছোটো-বড়ো শিল্পী ও বণিকরা একান্তভাবেই নগরবাসী ছিলেন বলে মনে হয়। নগর সমাজের এই শিল্পীবণিকরাই ধনোৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

অবশ্য নগরের শ্রেণিভেদ ছিল এবং সেই অনুসারে বিভিন্ন নগরে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণিক প্রাধান্য ছিল। যেমন, প্রশাসনিক কেন্দ্রে শাসকশ্রেণি, তীর্থক্ষেত্র ব্রাহ্মণ পুরোহিত শ্রেণি শিক্ষাকেন্দ্র ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত, বৌদ্ধ ও জৈন পর্যটকদের নিয়ে গঠিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি, বন্দর নগরে বণিকশ্রেণি এবং দুর্গনগরী বা সামরিক ঘাঁটিতে যুদ্ধাস্ত্রবাহী সমরনায়ক ও সেনারা বা সামরিক শ্রেণি প্রাধান্য পেয়েছিল। অবশ্য কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে যে নগর পরিকল্পনা দেখা যায়, তাতে মনে হয় রাজধানীতে উপরোন্ত সকল শ্রেণির বসতি ছিল।

নগর সমাজে রজক, নাপিত, নট প্রভৃতি সমাজসেবকেরাও বসবাস করত। সমাজসেবক শ্রেণি ধনোৎপাদনে যুক্ত ছিল না বটে, তবে তাদের সেবা সমাজের পক্ষে অবশ্য প্রয়োজনীয় ছিল। নগরের বাইরে বসবাস করত শ্রমজীবীর অন্তর্গত ডোম, বাগদি, বাউড়ি, চন্ডাল, তোলাবাহী, মাংসচ্ছেদ, কর্মকার প্রভৃতি অন্ত্যজ জাতি। নগর সমাজের পক্ষে তাদের মূল্য কম ছিল না।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading