গৌড়বঙ্গের সামাজিক জীবনে ধর্মীয় ক্রিয়াকর্ম ও আচার-অনুষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ বীনা অধিকার করেছিল। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে ব্রত, নিয়ম, আচার-অনুষ্ঠানের রিশিষ গুরুত্ব ছিল। ব্যক্তির জীবনে প্রচলিত দশসংস্কার পরিবারের মতো সীমাবদ্ধতা শহরেও সেগুলি পারিপার্শ্বিক সমাজকেও স্পর্শ করত। ব্রাহ্মণদের বসতি বিস্তারের কেউ থেকে ধীরে ধীরে এইসব সংস্কারের অনুষ্ঠান প্রবর্তিত হতে থাকে। একাদশ-দ্বাদশ ডোঙ্গীর মধ্যে বাংলায় বৈদিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটায় শৌত ও স্মার্ত সংস্কার অনুষ্ঠানাদি বিশেষভাবে স্বীকৃতিলাভ করে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ভট্টভবদেব জীমূতবাহন, অনিরুদ্ধভট্ট, বল্লালসেন এবং অন্যান্য স্মৃতিকারদের নিবন্ধাদি থেকে। এইসব স্মৃতি নিবন্ধে অবশ্য ব্রাহ্মণ পরিবারে অনুষ্ঠেয় সংস্কারাদির কথা বিশেষভাবে ব্যাখ্যায়িত হয়েছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের বিভিন্ন স্তরে এইসব অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল। যেমন-গর্ভাধান, পুংসবন, সীমন্তোন্নয়ন, শোষ্যস্তীহোম, জাতকর্মন, নিষ্ক্রমণ, নামকরণ, পৌষ্টিকমন, অন্নপ্রাশন, নৈমিত্তিক পুত্র-মুদ্ধাধিজ্ঞান, চূড়াকরণ, উপনয়ন, সাবিত্রচরুহোম, সমাবর্তন বিবাহ এবং মালাকমণ-এইসব অনুষ্ঠানে কূশন্ডিকা এবং বিভিন্ন হোমের অনুষ্ঠান করা হত। বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ সহযোগে সহাব্যাহৃতি হোম এবং শাট্টায়ন হোম উল্লেখযোগ্য। সাধারণত সামবেদী ব্রাহ্মণদের মধ্যেই এগুলির বিশেষ প্রচলন ছিল। বিবাহপ্রথা সামাজিক জীবনে নিঃসংশয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জীমূতবাহনের দায়ভাগ এবং ভট্টভবদেবের সম্বন্ধবিবেক থেকে জানা যায় যে সেকালে কন্যাদের বাল্যবিবাহ প্রচলিত ছিল। অর্থাৎ, পূর্ণ বয়োপ্রাপ্তির আগেই কন্যার বিবাহ দেওয়া প্রচলন ছিল। বর এবং কন্যার সম্বন্দ্ব করার সময় সপিন্ড, সগোত্র এবং সমান প্রবর প্রভৃতি বিষয়ে বিবেচনা করা হত। ব্রাহ্মণদের মধ্যে ব্রাহ্ম বিবাহ প্রচলিত ছিল। এই বিবাহের বিশদ বিবরণ আছে ভবদেবের কর্মানুষ্ঠান পদ্ধতিতে। দৈব, আর্য, প্রাজাপতা প্রভৃতি বিবাহ পদ্ধতিও অজ্ঞাত ছিল না। সাধারণত এক পুরুষের এক বিবাহ প্রচলিত ছিল। কিন্তু এক পুরুষের একাধিক পত্নীর কথাও জানা যায়। বিবাহাদি অনুষ্ঠানে শৌত এবং স্মর্তি বিধিনিয়ম যেমন প্রতিপালিত। হত তেমনই আঞ্চলিক প্রন্থা, পরিবারিক আভিজাত্য এবং কুসংস্কারাদি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। স্থান অধিকার করেছিল।
উপরোন্ত বৈদিক ক্রিয়াকর্ম, আচার-অনুষ্ঠান বস্তুতপক্ষে পরিবারকেন্দ্রিক ছিল, যদিও তার সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে সামাজিক অনুষ্ঠান (যেমন- দূর্গাপূজা, গণেশ-সরস্বতী-ইন্দ্র-মনসা এবং কাম-অথবা মদনের পূজা, বসন্ত ঋতুতে হোলাকা বা হোলি উৎসব, শিবরাত্রি ব্রত, দ্যূত প্রতিপদ, পাষাণ চতুর্দশী প্রভৃতি) উপলক্ষ্যে সমাজের সকল মানুষ সমবেত হয়ে উৎসবে মেতে উঠতেন। বরেন্দ্রীতে দুর্গাপূজার বিবরণ পাওয়া যায় সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’-এ। কালিকাপুরাণ এবং কালবিবেক-এ বিজয়া দশমীতে শারদোৎসবের বিস্তৃত বিবরণ আছে। কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, দীপান্বিতা, আকাশ-প্রদীপ, জন্মাষ্টমী অক্ষয় তৃতীয়া, অশোকাষ্টমী, অগস্ত্য অর্ঘ্য প্রভৃতি অনুষ্ঠান গৌড় বঙ্গের সমাজজীবনয়ে ঐশ্চর্যমণ্ডিত করেছিল। শুধু তাই নয়, এইসব ধর্মীয় উৎসব ভারতীয় প্রেক্ষাপটে বাঙালিয়া বৈশিষ্ট্যকে সমুজ্জ্বল করে তুলেছিল।
বস্তুতপক্ষে ধর্মীয় ক্রিয়াকর্ম, আচার-অনুষ্ঠান ব্যতীত গৌড় বঙ্গের সামাজিক সাধারণ জীবন সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া যায়। বৈদেশিক বিবরণ, প্রাচীন সাহিত্য, লেখমালা, ভাস্কর্য প্রভৃতি সূত্র থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তার ব্যাপ্তি খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত। সাহিত্যগত উপাদানের মতে একমাত্র চর্যাপদ খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী থেকে রচিত হয়। সমাজ বিষয়ক তথ্যাদির জন্য অন্যান্য যেসব সাহিত্য প্রশ্নের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয় সেগুলির রচনাকাল দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ ও চতুদর্শ শতাব্দী পর্যন্ত। প্রাচীন গৌড় বঙ্গোর সামাজিক জীবনের কোনো ধারাবাহিক ইতিহাস রচনা করা সম্ভব না হলেও এ পর্যন্ত প্রাপ্ত উপাদানাদির ভিত্তিতে সমাজজীবনের কোনো-কোনো দ্বীপের ওপর আলোকপাত করা সম্ভব।