গৌড় আমলের নারীদের অবস্থান সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লেখো। (Write an essay about the position of women of Gour.)

বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’ থেকে বঙ্গনারী সম্পর্কে আমরা যে তথ্য পাই সেখানে বলা হয়েছে যে নম্রস্বভাবা, মধুর ভাষিণী, মাধুর্যমণ্ডিতা বঙ্গনারী ছিলেন, অসূর্যস্পর্শ্যা। রাজঅন্তঃপুরের মহিলারা বিশেষত পর্দানশীন ছিলেন। স্ত্রী-স্বাধীনতা ছিল না। বাল্যে পিতা, যৌবনে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্রের ওপর নির্ভরশীলতা নারীর জীবনকে নিয়ন্ত্রণ। করত। কিন্তু তার জন্য কোনো গ্লানিবোধ ছিল বলে মনে হয় না, কারণ স্নেহ, প্রেম ও কর্তব্যবোধের প্রেরণা তাদের জীবনকে স্বচ্ছন্দ গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেত। লক্ষণ সেনের অন্যতম সভাকবি ধোয়ী-র ‘পবনদূতম’ কাব্যে সেনদের রাজধানী বিজয়পুরের নারীদের পর্দাপ্রথার কথা অস্পষ্ট থাকলেও নারীরা যে প্রেমপত্র রচনা করতেন তার উল্লেখ ধোয়ী করেছেন। তাতে মনে হয় যে সে যুগে স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন ছিল এবং হয়তো অনেক বিদুষী মহিলারও আবির্ভাব ঘটেছিল।

বঙ্গে একপুরুষের একবিবাহ প্রচলিত ছিল এ কথা পূর্বেই বলা হয়েছে। তবে বহুবিবাহ অজ্ঞাত ছিল না। সে কারণে নারীর বিবাহিত জীবন সর্বদা সুখের হত না। জীমূতবাহনের ‘দায়ভাগ’ থেকে জানা যায় যে, বিবাহিত মহিলারা অনেক সময় অর্থোপার্জন করে স্বামীকে সাহায্য করতেন। হস্তশিল্প ছিল নারীদের প্রধান অবলম্বন। সুতাকাটা, তাঁতবোনা এবং অন্যান্য কুটিরশিল্পে তারা নিজেদের নিয়োজিত করতেন। অনুমান করা যেতে পারে যে, সমাজের নিম্নবর্গের পরিবারস্থ নারীদেরই এইভাবে জীবিকা অর্জন করতে হত। অনেক সময় নারীরা উপার্জনশীল হলে তাদের স্বামীরা আলস্যপরায়ণ হয়ে পড়তেন। তাই কখনো-কখনো দেখা যায় যে শ্রমিক পত্নীকে উৎকোচ দিয়ে মনিবেরা শ্রমিককে কাজে যোগদানে প্ররোচিত করতে চাইতেন।

বৃহস্বর্ম পুরাণে স্বামীর মৃত্যুর পর মৃত স্বামীর চিতায় পতিব্রতা স্ত্রীর আত্মাহুতি দানের বিধান পাওয়া যায়। সম্ভবত সতীদাহপ্রথা দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীর আগে প্রচলিত হয়নি। তবে সকল বিধবা নারীই যে সতী হতে চাইতেন তা নয়, কারণ বিধবাদের জীবনযাপন পদ্ধতি সম্পর্কে নিয়মাবিধি লিপিবদ্ধ করে গেছেন স্মৃতি-নিবন্ধকারেরা। ভবদেবের প্রায়শ্চিত্ত প্রকরণ এবং বৃহদ্ধর্মপুরাণে বিধান দেওয়া হয়েছে যে স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা স্ত্রী নিরামিষ আহার করবেন এবং সংযমী জীবনযাপন করবেন। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান দিতে বিধবাদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল। জীমূতবাহনের দায়ভাগে বিধান দেওয়া হয়েছে যে স্বামীর মৃত্যুর পর কোনো পুত্রসন্তান না থাকলে তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন বিধবা স্ত্রী। সম্পত্তির উত্তরাধিকার ভোগ করার দু-একটি শর্তও দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, বিধবা স্ত্রীকে শ্বশুরালয়ে থাকতে হবে এবং শুদ্ধ ও সংযত জীবনযাপন করতে হবে, দ্বিতীয়ত, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি দান, বিক্রয় বা বন্ধক দেওয়ার অধিকারী তিনি হবেন না। প্রসঙ্গক্রমে বলা হয়েছে যে বিধবা স্ত্রী পিত্রালয়ে গিয়ে বসবাস করতে পারেন যদি সেখানে তার স্বামীর কোনো সপিন্ড পুরুষ আত্মীয় না থাকেন।

যদিও নৈতিকতার ক্ষেত্রে নারীর স্থান গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে মনে হয়। কারণ নারীর সতীত্বের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপিত হত। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বলা হয়েছে যে, বলপূর্বক কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সতীত্ব নাশ করলে তাকে সমাজে পতিতা বলে ঘোষণা করা হত না বরং প্রায়শ্চিত্ত করলেই তিনি পবিত্রতালাভ করতেন।

সেকালে ক্রীতদাসী রাখার প্রথা প্রচলিত ছিল। এই তথ্য জানা যায় ‘দায়ভাগ’ থেকে। আবার দেবদাসী প্রথারও প্রচলন ছিল। কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’ থেকে জানা যায় খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে পুণ্ড্রবর্ধনের এক মন্দিরে কমলা নামের এক বারবনিতা নতকী ছিলেন। বিজয় সেনের ‘দেওপাড়া প্রশস্তি’ এবং ভট্টভবদেবের ‘ভুবনেশ্বর প্রশস্তিতে বলা হয়েছে যে তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মন্দিরের প্রত্যেকটিতে একশত করে সুন্দরী নর্তকী ছিলেন।

দেবদাসীরা ছিলেন সকলেই সংগীতজ্ঞা ও নৃত্যপটিয়সী। দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃতা এবং মন্দিরের নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হলেও দেবদাসীদের অবস্থান ছিল সমাজে বারবনিতাদের সঙ্গে তুলনীয়।

                             যাই হোক, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার সূত্র যে ব্যাভিচারের সূত্রপাত হয়েছিল তার কারণ অনুসন্ধান করা হয়েছে। অনেকে মনে করেন যে একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধধর্মে তান্ত্রিকতার প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। সেই তান্ত্রিক আচার-অনুষ্ঠানের দ্বারা সমাজ অনেকাংশে প্রভাবিত হয়। অন্যদিকে কেউ কেউ মানে করেন যে বিশেষত সেনযুগে সাহিত্য ও শিল্পকলায় এবং ধর্ম সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতে যে রুচিশীলতার অভাব, বিলাসব্যসনের মত্ততায় ব্যভিচারের প্রশ্রয় পরিলক্ষিত হয়, তার দ্বারাই সমাজের বিশেষত নগর সমাজের নৈতিক মানের যথেষ্ট অবনতি অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading