চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূল উদ্দেশ্য
কর্নওয়ালিশ বড়ােলাট হয়ে ভারতে এসে (১৭৮৬ খ্রি.) ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন করেন। তার শাসনকালে এটি ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পেছনে বেশ কিছু উদ্দেশ্য ছিল, যেমন一
- সমর্থক গােষ্ঠীর উদ্ভব: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের মাধ্যমে ভারতে ইংরেজদের অনুগামী একটি নতুন অভিজাত শ্রেণির উত্থান ঘটবে।
- সুনিশ্চিত আয়: কোম্পানির আশা ছিল যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করলে তারা নিয়মিত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব পাবে। এর ফলে তাদের আয়ের অনিশ্চয়তা দূর হবে।
- বাজেট তৈরির সুবিধা: রাজস্ব থেকে প্রতি বছর সুনিশ্চিত আয় হলে সরকারের পক্ষে বার্ষিক আয়ব্যয়ের বাজেট তৈরির কাজ সহজ হবে।
- দেশের সমৃদ্ধি: জমিতে স্থায়ী অধিকার পেয়ে জমিদাররা কৃষি ও কৃষকের উন্নতির জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করবেন। এতে দেশের সমৃদ্ধি বাড়বে এবং পরােক্ষে কোম্পানিরই লাভ হবে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব
বাংলার ইতিহাসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই ব্যবস্থা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার ভূমি ও সমাজ উভয়ক্ষেত্রেই এক বিরাট পরিবর্তন আনে। জে. সি. মার্শম্যান চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে ব্রিটিশ সরকারের এক দৃঢ়, সাহসী ও বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন। ভারতের সমাজ ও অর্থনীতিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের গভীর প্রভাব পড়েছিল
বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে চিরস্থায়ী বন্দাবস্তের গুরুত্ব অপরিসীম । এই বন্দোবস্ত কোম্পানি , জমিদার ও কৃষক সমাজকে নানা ভাবে প্রভাবিত করে , যদিও এই প্রভাব সকলকে সমভাবে প্রভাবিত করেনি এবং সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রভাবের মাত্রাতেও পরিবর্তন ঘটেছে ।
বাংলার কৃষক শ্রেণির উপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলার রায়ত বা কৃষক সম্প্রদায় । জমির উপর জমিদারের মালিকানা স্বত্ব স্বীকৃত হলেও জমির উপর কৃষকের কোনাে মালিকানা স্বত্ব ছিল না । জমিদার প্রজাকে ইচ্ছে মতাে জমি থেকে উৎখাত করতে পারতেন এবং প্রজার অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে জমিদারের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল ছিল । এম . জে বিভিরাজি বলেন যে , প্রজাদের স্বার্থ উপেক্ষা করে কেবলমাত্র জমিদারদের সঙ্গে চুক্তি করা হয় — এটা একটা ভ্রান্তি ও চরম অন্যায় ।
‘মহাজন’ শ্রেণির আবির্ভাব : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে পত্তনি প্রথা ও বিভিন্ন মধ্যস্বত্বের উদ্ভব হয়, যার ফলে প্রজা- জমিদার সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটে । জমিদাররা শহরে বাস করায় তাদের সঙ্গে প্রজাদের কোনাে সম্পর্ক ছিল না । নায়েব – গােমস্তা ও পত্তনিদারদের অত্যাচারে তাদের অবস্থা শােচনীয় হয়ে ওঠে । আগে প্রয়ােজনে প্রজারা ‘তকাভি’ ঋণ পেত কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতি ‘মহাজন’ সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে ।
প্রজাদের অধিকার অরক্ষিত : কর্ণওয়ালিশ আশা করেছিলেন যে , তিনি যেমন জমিদারদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছেন সেইরকম জমিদাররাও প্রজাদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে তাদের পাট্টা দেবেন । যাতে জমিদার ও প্রজার অধিকার ও দায়িত্ব লিপিবদ্ধ থাকবে । জমিদাররা এধরনের কোনাে পাট্টা দেননি এবং প্রজারাও এ ব্যাপারে যথেষ্টই অনাগ্রহী ছিল । এর ফলে রায়তদের অধিকার অরক্ষিতই থাকে । সিটনকার বলেন যে, “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদারদের স্বার্থরক্ষা করে , প্রজা স্বার্থ রহিত করে এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিসর্জন দেয় ।” ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির পরিচালক সভা লিখেছেন— “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যাদের সঙ্গে হয়েছিল তাদের সত্যিকারের ভূস্বামী বলে ধরে নেওয়ার ফলেই অন্যান্যদের অধিকার ও স্বার্থ প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ।