“ছেলে মেয়ে দুই-ই সমান সুবর্ণ, হেলা করিস না” কোন্ প্রসঙ্গে কার কথা বলা হয়েছে? প্রসঙ্গটি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করো।

“… ছেলে মেয়ে দুই-ই সমান সুবর্ণ, হেলা করিস না” — প্রসঙ্গ এবং বিশদ ব্যাখ্যা

এই পংক্তিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নষ্টনীড় নাটকের অন্তর্গত, যেখানে কবি রামমোহন তাঁর স্ত্রীর শৈলজাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “ছেলে মেয়ে দুই-ই সমান সুবর্ণ, হেলা করিস না।” এই বক্তব্যটির মধ্যে গূঢ় অর্থ নিহিত রয়েছে, যা শুধু পারিবারিক সম্পর্কের প্রতি রামমোহনের দৃষ্টিভঙ্গি নয়, বরং সমসাময়িক সামাজিক ব্যবস্থার প্রতি তাঁর অসন্তোষ এবং এক ধরনের প্রগতিশীল মনোভাবের প্রতিফলন।

প্রসঙ্গের ব্যাখ্যা

নাটকটির মূল কাহিনী revolves around রামমোহন, শৈলজা এবং তাঁদের সন্তানদের, বিশেষত তাঁদের মেয়ে রাহুলা এবং ছেলে রতন। শৈলজা, রামমোহনের স্ত্রী, মূলত ছেলের প্রতি অধিক আগ্রহী, যেহেতু তখনকার সমাজে ছেলেদের প্রতি বেশি মনোযোগ দেওয়া হত, কারণ তারা পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণ এবং উত্তরাধিকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হতো। মেয়ে, বিশেষত সেই সময়ে, অনেকের কাছে কম গুরুত্ব পেত। রামমোহন, একদিকে যেখানে নারীর শিক্ষার এবং তাদের উন্নতির পক্ষে ছিলেন, সেখানে তাঁর স্ত্রীর এই অনিচ্ছুকতা দেখে তিনি মর্মাহত হন।

এই সৃষ্টিতে রামমোহনের চরিত্রটি একটি সমাজ সংস্কারের প্রতীক হয়ে ওঠে। তিনি জানেন, সমাজে পুরুষ এবং মহিলার মধ্যে অমীমাংসিত বৈষম্য বিদ্যমান, এবং সে জন্য তিনি তার স্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার চেষ্টা করছেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজের পুরনো সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে সমানাধিকারের একটি নতুন ধারণা প্রতিষ্ঠা করা।

চরিত্রের গভীরতা ও মনস্তাত্ত্বিক দিক

রামমোহন চরিত্রটি একজন আধুনিক চিন্তাধারার মানুষ, যার দৃষ্টিতে ছেলে-মেয়ে উভয়ই সমান। তিনি তাঁর স্ত্রীর কাছে ছেলের প্রতি যে বাড়তি যত্ন ও প্রশ্রয় দেখতে পান, তাতে তিনি ব্যথিত হন এবং বলেন, “ছেলে মেয়ে দুই-ই সমান সুবর্ণ, হেলা করিস না।” এখানে রামমোহন শুধু শৈলজাকে তার মেয়ে রাহুলার প্রতি সঠিক মনোভাব গড়ে তুলতে বলছেন না, বরং তিনি সমাজের একটি গভীর সমস্যার দিকে আঙুল তুলছেন — নারীশিশুদের প্রতি অবহেলা এবং তাদের প্রতি যে বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, তা একেবারে অবান্তর এবং অযৌক্তিক।

রামমোহনের বক্তব্যের মধ্যে যেমন সামাজিক অবস্থার প্রতিফলন রয়েছে, তেমনি এতে তাঁর পারিবারিক জীবন ও সম্পর্কের একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক দিকও ফুটে ওঠে। তাঁর স্ত্রী শৈলজা প্রথাগত, পুরনো ধারার মানুষ, যিনি ছেলেকে অধিক মূল্য দেন, কিন্তু রাহুলাকে মূল্যায়ন করতে চান না। রামমোহন জানেন যে, এই ধরনের পুরনো দৃষ্টিভঙ্গি কেবল ব্যক্তিগত জীবনেই ক্ষতি করে না, বরং একটি বৃহত্তর সামাজিক সমস্যার জন্ম দেয়।

সমাজের পুরনো দৃষ্টিভঙ্গি ও রামমোহনের প্রগতি

নাটকটির মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজের পুরনো মানসিকতার বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। সেই সময়ের ভারতীয় সমাজে, বিশেষত মধ্যবিত্ত পরিবারে, ছেলের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া হত। ছেলের শিরোমণি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল এবং তার উপরই পরিবারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করত। এর ফলে মেয়েদের প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা বেড়ে যেত, যাদেরকে শুধু বিবাহের পর অন্য পরিবারের সদস্য হিসেবে দেখে নেওয়া হতো।

রবীন্দ্রনাথ, রামমোহনের চরিত্রের মাধ্যমে, এই প্রথাগত সমাজের বিরোধিতা করেন। তিনি জানান যে, সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে যে পার্থক্য করা হয়, সেটি অযৌক্তিক। মেয়ে জন্মগ্রহণ করলে তাকে কম মূল্যায়ন করা হয়, অথচ ছেলে ও মেয়ে দুটি সমানভাবে মূল্যবান, তাদের প্রতি একজাতীয় শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা দেখানো উচিত।

রামমোহন শুধুমাত্র স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন, তবে এর মাধ্যমে তিনি সমাজেরও একটি বৃহৎ শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যে, মেয়েদেরও ছেলেদের মতো সমান সুযোগ এবং মর্যাদা দেওয়া হোক। তাই তিনি বলেন, “ছেলে মেয়ে দুই-ই সমান সুবর্ণ, হেলা করিস না,” অর্থাৎ, তোমার ছেলে এবং মেয়ে দু’জনেই সমান গুরুত্বপূর্ণ, তাদের প্রতি অবহেলা বা পক্ষপাতিত্ব না করে সমানভাবে ভালোবাসো।

নারীর অবস্থান এবং শিক্ষা

রামমোহনের বক্তব্যের মধ্যে একটি গভীর মানবিক আবেদন রয়েছে, যা শুধু পারিবারিক বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি সমাজসংশ্লিষ্ট দাবি। তিনি বুঝতে পারছেন যে, সমাজে নারীর অবস্থান যথাযথ নয় এবং পুরুষের থেকে তাঁর মর্যাদা কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মেয়েদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করার ফলস্বরূপ পুরো সমাজই এক অবনতি পথে চলেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্য তিনি প্রথমে পারিবারিক ক্ষেত্র থেকেই শুরু করতে চান।

নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও আধুনিকতার প্রভাব

রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্য একটি আধুনিক চিন্তাধারার প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠে। ১৯শ শতাব্দীর শেষের দিকে যখন ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতীয় সমাজের মধ্যে নানা সামাজিক আন্দোলন ও পরিবর্তন চলছিল, তখন রবীন্দ্রনাথ তার সাহিত্যকর্মে নারীর অধিকার, শিক্ষা, স্বাধীনতা ও সমান মর্যাদার পক্ষে কণ্ঠ তুলেছিলেন। নষ্টনীড় নাটকে রামমোহনের মাধ্যমে তিনি এই সামাজিক পরিবর্তনের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেছেন।

উপসংহার

“ছেলে মেয়ে দুই-ই সমান সুবর্ণ, হেলা করিস না” — এই পঙক্তিটি রামমোহনের একটি সামাজিক ও পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। তিনি শৈলজাকে এবং সমাজকে জানান যে, পুরুষ ও মহিলার মধ্যে কোনো বৈষম্য থাকা উচিত নয়। ছেলে এবং মেয়ে উভয়েই সমানভাবে মূল্যবান, তাদের প্রতি অভিন্ন মনোভাব এবং সমান যত্ন প্রয়োজন। এই বার্তা রবীন্দ্রনাথের সমাজসংস্কারের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস এবং নারী-পুরুষ সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার এক শক্তিশালী আহ্বান।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading