ছোটগল্প হিসেবে ‘শাস্তি’ গল্পের সার্থকতা সংক্ষেপে বিচার করো।

‘শাস্তি’ গল্পের সার্থকতা:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘শাস্তি’ গল্পটি বাংলা ছোটগল্প সাহিত্যের এক অনন্য সৃষ্টি। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১৪ সালে এবং পরবর্তীতে ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। গল্পটি শুধু কাহিনির গুণেই নয়, তার চরিত্রচিত্রণ, সমাজচেতনা, এবং অন্তর্নিহিত মানবিক বেদনার জন্যও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

১. প্লটের সরলতা ও গভীরতা:

‘শাস্তি’ গল্পের মূল কাহিনি অত্যন্ত সরল হলেও এর অন্তর্নিহিত ভাব অত্যন্ত গভীর। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র চিদাম ও তার স্ত্রী চন্দরা, এবং চিদামের বড় ভাই দুখিরাম ও তার স্ত্রী রাধা—এই চারজনের মধ্যকার সম্পর্ক ও সমাজের অবিচার গল্পটির মূল উপজীব্য। একটি ক্ষুদ্র ভুল বোঝাবুঝি এবং দুখিরামের রাগের বশে রাধাকে হত্যা করার পর চিদাম নিজের স্ত্রী চন্দরাকে দোষী সাব্যস্ত করার পরিকল্পনা করে। চন্দ্রা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডকে বরণ করে নেয়।

২. চরিত্রচিত্রণ:

গল্পের চরিত্ররা বাস্তবধর্মী এবং জীবন্ত।

চন্দরা: চন্দরা একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নারী, যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নত করে না। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও সে আত্মসম্মান রক্ষা করে।

চিদাম: চিদাম একটি সংকটময় পরিস্থিতিতে নিজের স্বার্থরক্ষার জন্য স্ত্রীকে বলি দিতে চায়।

দুখিরাম: দুখিরাম তার রাগের বশে যে কাজটি করে, তার পরিণতি তাকে নিঃশেষ করে দেয়।

রাধা: রাধা একজন সাধারণ গৃহবধূ, যার জীবন একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মাধ্যমে শেষ হয়ে যায়।

প্রতিটি চরিত্র তাদের পরিবেশ ও সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং এই সম্পর্কের দ্বন্দ্ব গল্পে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

৩. সমাজচিত্র ও বাস্তবতা:

গল্পে তৎকালীন সমাজব্যবস্থার নিপীড়ন, বিশেষ করে নারীর প্রতি অবিচার স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। চন্দরার শাস্তি সমাজের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর অসংগতি এবং বিচার ব্যবস্থার অন্যায়কে প্রতিফলিত করে। নারীর আত্মসম্মান এবং পুরুষের ক্ষমতার অপব্যবহার গল্পের কেন্দ্রে অবস্থান করে।

৪. নারীমুক্তির বার্তা:

‘শাস্তি’ গল্পটি নারীর সাহস, আত্মমর্যাদা এবং প্রতিরোধের প্রতীক। চন্দরার চরিত্রের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ নারীচরিত্রের যে দৃঢ়তা এবং আত্মসম্মানবোধ তুলে ধরেছেন, তা গল্পটিকে সময়োত্তীর্ণ করে তুলেছে।

৫. ভাষাশৈলী ও রচনা কৌশল:

রবীন্দ্রনাথের ভাষাশৈলী গল্পের অন্যতম সার্থক দিক। সংলাপ, বর্ণনা এবং পরিবেশ চিত্রণে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সংলাপগুলিতে চরিত্রগুলির মানসিক টানাপোড়েন এবং পরিস্থিতির জটিলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

৬. নৈতিকতা ও বার্তা:

‘শাস্তি’ গল্পটি আমাদের নৈতিকতার এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়—একজন মানুষ নিজের স্বার্থরক্ষার জন্য কতদূর যেতে পারে? চন্দরার আত্মমর্যাদাপূর্ণ অবস্থান আমাদের অন্তরে গভীর দাগ কাটে।

উপসংহার:

‘শাস্তি’ গল্পটি তার কাহিনির নাটকীয়তা, বাস্তবতা, এবং মানবিকতার মর্মস্পর্শী চিত্রণের কারণে বাংলা ছোটগল্প সাহিত্যে একটি মাইলফলক। চন্দরার চরিত্র এবং তার আত্মত্যাগ আজও পাঠকের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। রবীন্দ্রনাথ এই গল্পের মাধ্যমে সমাজের অন্যায়, পুরুষতান্ত্রিকতার নিপীড়ন এবং নৈতিক সংকটকে অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে উপস্থাপন করেছেন। গল্পটি শুধু একটি ছোটগল্প নয়, এটি একটি কালজয়ী মানবিক দলিল।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading