জন স্টুয়ার্ট মিলের স্বাধীনতার তত্ত্ব –
জ.এস. মিলের স্বাধীনতার তত্ত্ব (John Stuart Mill’s Theory of Liberty) একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক তত্ত্ব যা ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতার মধ্যে সঠিক সমন্বয়ের প্রশ্ন তুলে ধরে। মিল তাঁর “On Liberty” (1859) গ্রন্থে স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একজন ব্যক্তি তার নিজের জীবনে যতটা সম্ভব স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে, ততই তার প্রকৃত স্বাধীনতা এবং উন্নতি সম্ভব। তবে, এই স্বাধীনতার কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা মিল তার তত্ত্বে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
মিলের স্বাধীনতার তত্ত্বের প্রধান দিকগুলি:
১. স্বাধীনতা ও ব্যক্তি অধিকার
মিলের মতে, ব্যক্তি স্বাধীনতা সমাজের মৌলিক অধিকার। তিনি বলেছিলেন যে, একজন ব্যক্তি তার জীবন, বিশ্বাস এবং কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকতে পারে যতক্ষণ না তার কর্মকাণ্ড অন্যের ক্ষতি বা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই ধারণাটি “হর্ম প্রিন্সিপল” (Harm Principle) নামে পরিচিত, যার অর্থ হলো, রাষ্ট্র বা সমাজ শুধু তখনই হস্তক্ষেপ করতে পারে যখন একজন ব্যক্তির কর্মকাণ্ড অন্যদের ক্ষতি বা বিপদ সৃষ্টি করে। নিজের সুখ বা কল্যাণের জন্য একজন ব্যক্তি যতটুকু স্বাধীনতা পেতে পারে, তার সীমা কেবল তখনই আসে যখন সে অন্যের অধিকার বা সুখ ক্ষতিগ্রস্ত করে।
২. “হর্ম প্রিন্সিপল” (Harm Principle)
মিলের স্বাধীনতার তত্ত্বের মূল ভিত্তি হলো “হর্ম প্রিন্সিপল”, যা তিনি বলেছেন:
“Only harm to others justifies interference in the actions of individuals.”
এই নীতির মাধ্যমে মিল বুঝাতে চেয়েছেন যে, রাষ্ট্র বা সমাজের কর্তব্য হলো ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো, তবে এটি তখনই হস্তক্ষেপ করবে যদি কোনো ব্যক্তি তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অন্যদের ক্ষতি করে। মিল বিশ্বাস করতেন যে, এমন কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ন্যায্য হবে যেখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অন্যদের জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।
৩. বিনামূল্যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
মিল বিশেষভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং চিন্তার স্বাধীনতা পছন্দ করতেন। তিনি বলেছিলেন যে, এক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি অন্যদের চিন্তা বা মতামতের বিরুদ্ধে কিছু বলে, তা যেন শাস্তির আওতায় না আসে। মিল মনে করতেন যে, সমাজের জন্য ভালো তখনই সম্ভব যখন বিভিন্ন মত এবং চিন্তা একে অপরের সাথে মুক্তভাবে বিতর্কিত হয়। এর মাধ্যমে সত্য উদ্ভাসিত হতে পারে।
৪. অধিকার এবং সমাজের কল্যাণ
মিলের স্বাধীনতার তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, তিনি ব্যক্তির স্বাধীনতার প্রতি সম্মান রেখে সমাজের কল্যাণও প্রচার করতে চেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একটি স্বাধীন সমাজের মধ্যে আলাদা আলাদা মতামত এবং কার্যকলাপ থাকলে তা সমাজের মঙ্গল আনতে সহায়ক হবে। তবে তিনি কখনও এই স্বাধীনতা সবার জন্য সমান বা একেবারে নিখুঁতভাবে আকাশচুম্বী রাখতে চাননি, বরং তিনি বলেছেন যে স্বাধীনতা এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যাতে এটি সমাজের কল্যাণের জন্য ক্ষতিকারক না হয়।
৫. গণতন্ত্র এবং সংখ্যালঘু অধিকার
মিল গণতন্ত্রের প্রবক্তা হলেও তিনি গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তাঁর মতে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার মতামত বা সিদ্ধান্ত এক্ষেত্রে সর্বদা ন্যায়সঙ্গত বা সঠিক হবে না। তিনি গণতন্ত্রের মধ্যে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা এবং তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, রাষ্ট্রের কাজ শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করা নয়, বরং ছোট, দুর্বল বা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষিত রাখা।
মিলের স্বাধীনতার তত্ত্বের সমালোচনা:
১. স্বাধীনতার সীমা নির্ধারণে অস্পষ্টতা
মিলের “হর্ম প্রিন্সিপল”-এর মূল বক্তব্য হলো, ব্যক্তি যতটুকু স্বাধীন থাকতে পারে, ততটুকু তার জীবনযাপন করতে দেওয়া উচিত, তবে এটি তখনই সীমাবদ্ধ হবে যখন তার কর্মকাণ্ড অন্যদের ক্ষতি করবে। কিন্তু এখানে ‘ক্ষতি’ বা ‘হানি’ কীভাবে নির্ধারণ করা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। একে নির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা কঠিন হতে পারে, বিশেষত যখন ক্ষতির সংজ্ঞা বা তা মাপার মানদণ্ডের ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত থাকতে পারে।
২. সংখ্যাগরিষ্ঠতার আধিপত্য
মিল গণতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন, তবে তাঁর ধারণা অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠদের ইচ্ছাই সবসময় যে সঠিক হবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই ধারণা গণতন্ত্রের সমালোচকরা বলছেন যে, গণতান্ত্রিক সরকার অনেক সময় সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষে কাজ করে এবং সংখ্যালঘুদের অধিকারকে অবহেলা করতে পারে, যা মিলের তত্ত্বের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
৩. মুক্তি বনাম সামাজিক দায়বদ্ধতা
মিলের স্বাধীনতার তত্ত্বের উপর একটি সমালোচনা হচ্ছে যে, তিনি ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন, কিন্তু কখনও কখনও সমাজের দায়বদ্ধতা বা সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার বিষয়ে তিনি পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেননি। অর্থাৎ, ব্যক্তি স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে গিয়ে সামাজিক দায়িত্ব এবং পরস্পরের প্রতি দায়িত্বের বিষয়টি অবহেলিত হতে পারে।
৪. ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য
মিল ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে থাকলেও, কখনও কখনও তাঁর তত্ত্বে একক ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। কিছু সমাজবদ্ধতার ক্ষেত্রে, এক ব্যক্তির স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সংঘর্ষ বা বিরোধ তৈরি হতে পারে, এবং সেই মুহূর্তে সরকারকে কীভাবে হস্তক্ষেপ করা উচিত তা স্পষ্ট নয়।
উপসংহার:
মিলের স্বাধীনতার তত্ত্ব আধুনিক রাজনীতি এবং নৈতিকতা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, বিশেষত ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধ ভূমিকা সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি। তবে এই তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা যেমন, ‘ক্ষতি’ বা ‘হানি’ ধারণার অস্পষ্টতা এবং গণতান্ত্রিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। তবে তা সত্ত্বেও, মিলের স্বাধীনতার তত্ত্ব এখনো বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং নৈতিক তর্ক-বিতর্কের একটি শক্তিশালী ভিত্তি।