জাপানের প্রেক্ষাপটে ‘রাষ্ট্র-পুঁজিবাদ’ শব্দটির অর্থ
ভূমিকা:
‘রাষ্ট্র-পুঁজিবাদ’ (State Capitalism) শব্দটি এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বোঝায় যেখানে রাষ্ট্র বা সরকার পুঁজিবাদী অর্থনীতি পরিচালনার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাধারণত, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বেসরকারি খাত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়, তবে রাষ্ট্র-পুঁজিবাদে রাষ্ট্রের হাতে প্রাধান্য থাকে, যদিও বেসরকারি খাতও সক্রিয়ভাবে কাজ করে। জাপানে ‘রাষ্ট্র-পুঁজিবাদ’ ধারণাটি বিশেষত মেইজি যুগের পর এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যখন সরকার নীতি এবং কর্মসূচির মাধ্যমে অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপ করেছিল। এই ধরনের ব্যবস্থার মধ্যে সরকার বিশেষভাবে শিল্প, ব্যাংকিং, বাণিজ্য এবং কৃষি খাতের ওপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে, তবে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানও লাভের জন্য কাজ করতে থাকে।
রাষ্ট্র-পুঁজিবাদ এবং জাপানের অর্থনীতি:
জাপানে রাষ্ট্র-পুঁজিবাদ বিশেষত মেইজি যুগে (১৮৬৮-১৯১২) সূচনা হয়। এই সময়ে জাপান তার প্রথাগত সমাজব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য পশ্চিমি ধাঁচে অর্থনৈতিক নীতির বাস্তবায়ন শুরু করে। জাপান সরকারের আধিকারিকদের দ্বারা পরিচালিত প্রকল্পগুলির মাধ্যমে, বিশেষভাবে যুদ্ধকালীন সময়ে, রাষ্ট্র-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, জাপান একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র-পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পরিণত হয়, যেখানে সরকার এবং বেসরকারি খাত একে অপরকে সহযোগিতা করে, এবং অর্থনীতি শাসন করে।
রাষ্ট্র-পুঁজিবাদী নীতির মূল বৈশিষ্ট্য:
১. রাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা: রাষ্ট্র-পুঁজিবাদে সরকারের সক্রিয় ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাপানে, সরকার মূলত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং সংস্কারের জন্য দায়ী ছিল। মেইজি রেস্টোরেশনের সময়, জাপান সরকার পশ্চিমি প্রযুক্তি এবং শিল্প গ্রহণের মাধ্যমে দেশটিকে আধুনিক করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। সরকার কোম্পানি স্থাপন, শিল্পায়ন, সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ, এবং বিদেশী বাণিজ্যকে সহায়তা করার জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২. বেসরকারি খাতের সমর্থন: রাষ্ট্র-পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়, বেসরকারি খাতও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে সরকার বেসরকারি খাতের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ এবং সহায়তা করে। জাপানে, এই সময়ে বড় বড় শিল্প গ্রুপ যেমন ‘জাইদান’ (Zaibatsu), অর্থাৎ বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, সমর্থিত হয়েছিল, যারা সরকারী নীতির সাথে সমন্বয় করে শিল্পায়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।
৩. বাণিজ্য ও শিল্পের উন্নয়ন: রাষ্ট্র-পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বাণিজ্য এবং শিল্পকে শক্তিশালী করার জন্য রাষ্ট্র যে নীতিমালা গ্রহণ করে, তা জাপানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, জাপান সরকার শক্তিশালী রপ্তানি নীতি গ্রহণ করে এবং দেশটির শিল্পক্ষেত্রকে পুনর্গঠন করে। সরকার বিদেশী প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক সহায়তা গ্রহণের মাধ্যমে দেশটির ভারী শিল্প, যন্ত্রপাতি, রসায়ন, ইলেকট্রনিক্স এবং অটোমোবাইল খাতে উন্নতি সাধন করে।
৪. সামরিক ও অর্থনৈতিক সমন্বয়: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, জাপানে রাষ্ট্র-পুঁজিবাদী নীতি সামরিক ও অর্থনৈতিক খাতের মধ্যে সমন্বয় তৈরি করে। যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে, জাপান সামরিক খাতের সাথে সম্পর্কিত শিল্প এবং অর্থনীতি পুনর্গঠন করার জন্য রাষ্ট্রের সহায়তা গ্রহণ করে। বিশেষভাবে, সরকার কৌশলগত শিল্পগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ রাখে, যাতে দেশটি সামরিক এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে পারে।
৫. সরকারি পরিকল্পনা ও প্রণোদনা: জাপানে রাষ্ট্র-পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সরকারের পরিকল্পনা ও প্রণোদনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরকার বাজারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে, এবং বিশেষভাবে বেসরকারি খাতের জন্য প্রণোদনা প্রদান করে। এতে শিল্প, পরিবহন, শক্তি উৎপাদন, এবং গবেষণা ও উন্নয়ন খাতের দিকে ব্যাপক বিনিয়োগ করা হয়।
রাষ্ট্র-পুঁজিবাদী জাপান:
জাপানের রাষ্ট্র-পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক লক্ষ্য করা যায় যা তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে:
১. মেইজি যুগের রাষ্ট্র–পুঁজিবাদ:
মেইজি যুগের সময়, জাপান সরকার বিদেশী পুঁজি এবং প্রযুক্তি গ্রহণ করে, এবং দেশে সামরিক, শিল্প ও অর্থনৈতিক আধুনিকীকরণ ঘটায়। সরকার, বিশেষত ‘জাইদান’ গ্রুপগুলির মাধ্যমে, দেশটির প্রধান শিল্পগুলোর বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। রেলপথ নির্মাণ, ভারী শিল্প, আধুনিক মুদ্রানীতি এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার উন্নতি এসব সরকারের পরিকল্পিত পদক্ষেপের ফল ছিল। এই নীতির মাধ্যমে জাপান একটি আধুনিক, শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
২. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাষ্ট্র–পুঁজিবাদ:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, জাপান দ্রুত তার অর্থনৈতিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করে। জাপানের সরকার বৃহত্তর শিল্প গ্রুপ এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা দেয়, যা আবার দেশটির সামরিক এবং অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে জাপান সরকার রপ্তানি কেন্দ্রিক শিল্পায়ন নীতির আওতায় শিল্পের বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এই সময়ে, জাপান বিশ্ববাজারে একটি বড় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়।
উপসংহার:
জাপানে রাষ্ট্র-পুঁজিবাদ এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল, যা রাষ্ট্রের দ্বারা পরিচালিত নীতিমালা এবং বেসরকারি খাতের কার্যক্রমের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি করেছে। মেইজি যুগের পরে, এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, জাপান সরকার শক্তিশালী শিল্পায়ন, বাণিজ্যিক নীতি এবং সামরিক শক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে, যা দেশটির আধুনিকীকরণ এবং বিশ্বে তার সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির বৃদ্ধি ঘটায়।