জাপানে শিল্পায়নের বিকাশের দিকে পরিচালিত বিভিন্ন পর্যায়গুলি পরীক্ষা করুন।

জাপানে শিল্পায়নের বিকাশের পর্যায়গুলি:

ভূমিকা:

জাপান, প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিকতার সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী শিল্প জাতিতে পরিণত হয়েছিল, যা পরবর্তীতে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা অর্জন করেছিল। এই শিল্পায়নের প্রক্রিয়া এক দীর্ঘ যাত্রার ফল, যা শোগুনেটের শেষ থেকে মেইজি পুনরুদ্ধার এবং পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে বিভিন্ন পর্যায়ে ঘটেছিল। শিল্পায়ন, বিশেষ করে আধুনিক শিল্প, কৃষি থেকে ভারী শিল্প এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিকাশ, জাপানের অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছিল। এটি শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ কাঠামো বদলে দেয়নি, বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও জাপানের ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

এই প্রবন্ধে, আমরা জাপানে শিল্পায়নের বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়গুলি বিশ্লেষণ করব, যা শোগুনেটের শেষ থেকে শুরু করে আধুনিক শিল্পে উন্নীত হওয়া পর্যন্ত ঘটেছিল।

১. শোগুনেট শাসনের সময়ে জাপানের প্রাথমিক শিল্প কাঠামো:

জাপানের শিল্পের ইতিহাস শোগুনেটের শাসনামলে (১৬০৩-১৮৬৭) একটি মেকানিক্যাল প্রক্রিয়া ছিল না, তবে দেশটি কিছু প্রাথমিক শিল্পের উন্নতি দেখেছিল। শোগুনেটের সময়ে শিল্প ছিল মূলত কৃষি, কাঠ এবং ধাতুবিদ্যার উপর নির্ভরশীল।

  • কৃষি: কৃষি ছিল জাপানের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ। শোগুনেটের সময় কৃষির বিকাশ ঘটেছিল, বিশেষত সেচ ব্যবস্থা ও উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছিল। কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধির মাধ্যমে শহরগুলির উত্থান এবং জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটেছিল।
  • হস্তশিল্প এবং ম্যানুফ্যাকচারিং: এই সময়ে হস্তশিল্প এবং ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পও প্রচলিত ছিল, যেমন রেশম তৈরি, সিল্ক, সিরামিক, হাতি শুঁড়ের কাজ, কাঠের তৈরি জিনিসপত্র ইত্যাদি। তবে এই শিল্পগুলি ছিল ছোট আকারে এবং প্রধানত ঘরোয়া বা স্থানীয় বাজারের জন্য উৎপাদিত।

২. মেইজি পুনরুদ্ধারের পর শিল্পায়ন:

মেইজি পুনরুদ্ধারের (১৮৬৮) পর জাপান একটি আধুনিক জাতিতে পরিণত হতে শুরু করে। এটি একটি ঐতিহাসিক সময়, যখন শোগুনেটের অবসানের পর রাজতন্ত্র পুনঃস্থাপিত হয় এবং জাপান পশ্চিমী প্রভাব গ্রহণ করতে শুরু করে। এই সময়ে জাপানে ব্যাপক সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে শিল্পায়নের উন্নয়ন ছিল একটি প্রধান লক্ষ্য।

  • প্রাথমিক শিল্পের ভিত্তি স্থাপন: মেইজি সরকার প্রথমে কৃষি ও শিল্পের ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার প্রণয়ন করে। বিদেশী প্রযুক্তি আমদানি এবং পশ্চিমী শিল্প মডেল অনুসরণ করে সরকার ভারী শিল্পের বিকাশের জন্য অনেক শিল্পের জন্য সরকারি সহায়তা প্রদান করতে থাকে।
  • সামরিক সাংস্কৃতিক খাতে বিনিয়োগ: মেইজি পুনরুদ্ধারের সময়, সরকার সাংস্কৃতিক এবং সামরিক খাতে বিনিয়োগ করেছিল, যা শিল্পায়নকে আরও ত্বরান্বিত করেছিল। এ সময় রেলওয়ে নির্মাণ, টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা, এবং শিল্প কারখানার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়েছিল।
  • শিল্পকারখানার গঠন: জাপান সরকার ১৮৭০-এর দশকে বেশ কিছু নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন করে, যেমন রেলওয়ে, শিপ বিল্ডিং, এবং টেক্সটাইল মিলগুলো। জাপানী সরকার প্রথমদিকে রাষ্ট্রীয় খাতে শিল্প উন্নয়নের জন্য উদ্যোগী ছিল, কিন্তু পরে ব্যক্তিগত খাতে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে ওঠে।

৩. আধুনিক শিল্পায়নের প্রবাহ:

মেইজি পুনরুদ্ধারের পরবর্তী কয়েক দশকে জাপান আধুনিক শিল্পায়নে প্রবেশ করে। এ সময়ে দেশে একাধিক শিল্পের উন্নতি ঘটে এবং ভারী শিল্পে প্রবৃদ্ধি শুরু হয়। কয়লা, লোহা, স্টিল, ও তামার মত ভারী শিল্পগুলির উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এই সময়ে বেশ কয়েকটি বড় শিল্প গোষ্ঠী গড়ে ওঠে।

  • ভারী শিল্পের উন্নতি: ১৮৯০-এর দশক থেকে ভারী শিল্পের প্রতি জাপানের আগ্রহ বাড়ে। সরকার কয়লা, লোহা, স্টিল, চিনি এবং অন্যান্য মৌলিক উপকরণ উৎপাদনের জন্য ব্যাপক বিনিয়োগ করে। নতুন প্রযুক্তি ও পশ্চিমী মডেল অনুসরণ করে দেশটি নিজেকে একটি শক্তিশালী ভারী শিল্প জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
  • শিল্পসম্পর্কিত সংস্কৃতি: ১৮৯০-১৯০০-এর দশকে আধুনিক শিল্পের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে জাপানে একটি নতুন শ্রেণী সৃষ্টি হয়—শ্রমিক শ্রেণী। এই সময়ে শ্রমিক আন্দোলন এবং শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।
  • ব্যাংকিং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা: শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করার জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ঋণ প্রদান এবং ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণের সুবিধা সৃষ্টি করে শিল্প খাতের উন্নতি সম্ভব হয়েছিল। মেইজি সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার উন্নয়ন জাপানের শিল্পায়নে বিপ্লব সৃষ্টি করে।

৪. শোয়া যুগের শিল্পায়ন:

শোয়া যুগ (১৯২৬-১৯৮৯) জাপানে শিল্পায়নের পরবর্তী ধাপ ছিল, যেখানে দেশটি বিশ্বজুড়ে শিল্প ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অন্যতম শক্তিশালী খেলোয়াড় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, জাপান এক নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো ও প্রযুক্তি দ্বারা শক্তিশালী শিল্পিক বৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়।

  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শিল্পায়ন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, জাপান একটি নতুন অর্থনৈতিক ভিত্তি স্থাপন করতে শুরু করে। যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে, দেশটি পুনর্গঠনের জন্য মার্কিন সাহায্য গ্রহণ করেছিল এবং নতুন শিল্প ক্ষেত্র, যেমন অটোমোবাইল এবং ইলেকট্রনিক্সের উৎপাদন শুরু হয়েছিল।
  • ত্বরিত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি: ১৯৫০-৬০-এর দশকে জাপান এক নতুন শিল্প-নির্ভর সমাজে পরিণত হয়। টেক্সটাইল, অটোমোবাইল, ইলেকট্রনিক্স, এবং স্টিল শিল্পে জাপান বিশ্ববাজারে নিজের স্থান প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। স্যামসাং, হিটাচি, সনি, তোশিবা, টয়োটা—এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলি বিশ্ববাজারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে শুরু করে।

৫. বিশ্ববাজারে জাপানের শক্তি প্রতিষ্ঠা:

জাপান ১৯৭০-৮০-এর দশকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ শিল্প দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। অটোমোবাইল, ইলেকট্রনিক্স, কম্পিউটার প্রযুক্তি, এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি উৎপাদনে জাপান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে থাকে।

উপসংহার:

জাপানের শিল্পায়ন একটি দীর্ঘ এবং ধাপে ধাপে বিকশিত প্রক্রিয়া, যা শোগুনেটের শাসন থেকে শুরু হয়ে মেইজি পুনরুদ্ধার, শোয়া যুগ, এবং আধুনিক সময় পর্যন্ত পৌঁছেছে। মেইজি পুনরুদ্ধার ছিল শিল্পায়নের প্রথম ধাপ, যেখানে পশ্চিমী প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক কাঠামো গ্রহণের মাধ্যমে জাপান আধুনিক শিল্পে প্রবেশ করে। পরবর্তী সময়ে, ভারী শিল্প, অটোমোবাইল, এবং ইলেকট্রনিক্সের মতো ক্ষেত্রগুলোতে জাপান বিশ্বব্যাপী আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading