মেঘনাদবধ কাব্য ১৯-শতকীয় বাঙালি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত কর্তৃক রচিত মহাকাব্য। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা দ্বিতীয় কাব্য । কাব্যটি কবির সর্বশ্রেষ্ঠ কবিকীর্তি। এই অমর মহাকাব্য প্রকাশের সঙ্গে আমরা কবির প্রতিভার পূর্ণ বিকাশকালে উপস্থিত হয়। ১৮৬১ সালে কাব্যটির দুইখণ্ডে প্রকাশ হয় । প্রথম খণ্ড(১–৫ সর্গ) ১৮৬১ সালের জানুয়ারী মাসে, এবং দ্বিতীয় খণ্ড (৬—৯ সর্গ) ঐ বৎসরের প্রথমার্ধে প্রকাশিত হয়। কাব্যটি মোট নয়টি সর্গে বিভক্ত। মেঘনাদবধ কাব্য হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণ অবলম্বনে রচিত, যদিও এর মধ্যে নানা বিদেশী মহাকাব্যের ছাপও সুস্পষ্ট।
মেঘনাদবধ কাব্যের প্রথম সর্গের নাম ‘অভিষেক’। এই সর্গের সূচনায় কবি বাগ্দেবী সরস্বতী ও দেবী কল্পনার আবাহন করেছেন। লঙ্কার রাজসভায় রাজা রাবণ বসে আছেন। ভগ্নদূত মকরাক্ষ এসে যুদ্ধে রাজপুত্র বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ দিলেন। পুত্রের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে রাবণ শোকে অভিভূত হলেন। মন্ত্রী সারণ তাকে সান্ত্বনা দিলেন। দূতের মুখে পুত্রের বীরত্বের কাহিনী শুনে যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা দেখতে রাবণ স্বয়ং প্রাসাদশিখরে আরোহণ করলেন। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি নিহত পুত্রের জন্য বিলাপ করতে লাগলেন। সেতুবন্ধনে রামকে সাহায্য করার জন্য সমুদ্রদেবতা বরুণকেও ধিক্কার দিলেন। তারপর ফিরে এসে বসলেন সভায়। রাবণের অন্যতমা পত্নী তথা বীরবাহুর মা চিত্রাঙ্গদা তার একমাত্র আত্মজ পুত্রের মৃত্যুতে আকুল হয়ে রাজসভায় ছুটে এলেন। বিলাপ করতে করতে তিনি সীতাহরণের জন্য রাবণকে ধিক্কার দিলেন। চিত্রাঙ্গদা সভা থেকে প্রস্থান করলে রাবণ স্বয়ং যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। রাক্ষসসেনার পদভারে পৃথিবী টলমল করে উঠল। তা শুনে শঙ্কিত হয়ে বরুণের পত্নী বারুণী যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের জন্য সখী মুরলাকে পাঠালেন লঙ্কার রাজলক্ষ্মীর মন্দিরে। মুরলা রাজলক্ষ্মীর কাছে গিয়ে যুদ্ধের সংবাদ শ্রবণ করলেন এবং এও শুনলেন যে রাবণের অপর পুত্র মহাবীর মেঘনাদ যুদ্ধে না গিয়ে প্রমোদ উদ্যানে বিহার করছেন। মুরলা ধাত্রী প্রভাষার ছদ্মবেশে মেঘনাদের কাছে গিয়ে যুদ্ধের সংবাদ ও রাবণের রণসজ্জার আয়োজনের কথা জানালেন। দেশের আপদকালের কথা বিস্মৃত হয়ে আমোদপ্রমোদে মেতে থাকার জন্য মেঘনাদ নিজেকে ধিক্কার জানিয়ে তখনই যুদ্ধে যাওয়ার সংকল্প নিলেন। পত্নী প্রমীলা কেঁদে বললেন, “কোথা প্রাণসখে, রাখি এ দাসীরে, কহ, চলিলা আপনি?” মেঘনাদ উত্তরে বললেন, “ত্বরায় আমি আসিব ফিরিয়া কল্যাণি, সমরে নাশি তোমার কল্যাণে, রাঘবে। বিদায় এবে দেহ, বিধুমুখি।”রাবণের কাছে গিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন মেঘনাদ। রামের সঙ্গে যুদ্ধে লঙ্কার অনেক পরাক্রমী বীর নিহত হয়েছেন, তাই রাবণ ইষ্টদেবের পূজা ও নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সমাপ্ত করে যুদ্ধে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন তার প্রিয় পুত্রকে। তারপর গঙ্গাজল দিয়ে শাস্ত্রবিধি অনুসারে সেনাপতিপদে মেঘনাদের অভিষেক করলেন।