ঠান্ডা যুদ্ধের রূপরেখা:
১. প্রেক্ষাপট:
- বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতি (1945): দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর, ইউরোপ এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে।
- মুখোমুখি দুই শক্তি: আমেরিকা (গণতান্ত্রিক, পুঁজিবাদী) এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন (কমিউনিস্ট, রাষ্ট্রীয় কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা) — এই দুই পরাশক্তির মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়।
২. ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা (1947):
- ট্রুম্যান ডকট্রিন (1947): মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান, কমিউনিজমের বিস্তার প্রতিরোধ করতে “Containment” নীতি ঘোষণা করেন।
- মার্শাল প্ল্যান (1948): ইউরোপীয় দেশগুলোর পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ।
- ব্রেটন উডস চুক্তি (1944): আন্তর্জাতিক মুদ্রা ও বাণিজ্য ব্যবস্থার উন্নতির জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গঠন।
৩. প্রধান ঘটনা ও সংকটসমূহ:
- বার্লিন ব্লকেড (1948-1949): সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব বার্লিনে রাস্তা এবং রেলপথ বন্ধ করে দেয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা বেলুন উড়িয়ে বার্লিনকে সরবরাহ করে।
- কোরিয়া যুদ্ধ (1950-1953): কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়া এবং পুঁজিবাদী দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে সংঘর্ষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এই সংঘর্ষে নিজেদের মিত্রদের সমর্থন দেয়।
- কিউবা মিসাইল সংকট (1962): সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় পারমাণবিক মিসাইল স্থাপন করলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বযুদ্ধের মুখে পড়ে। সংকটটি শেষ হয় পারমাণবিক যুদ্ধের আগেই, এবং কিউবা থেকে মিসাইল সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
৪. ঠান্ডা যুদ্ধের বৈশ্বিক প্রভাব:
- ন্যাটো (NATO) ও ওয়ারশ-প্যাক্ট: আমেরিকা নেতৃত্বাধীন ন্যাটো (North Atlantic Treaty Organization) এবং সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন ওয়ারশ-প্যাক্ট সামরিক জোট গঠন।
- দ্বিতীয় বিশ্বে নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতা: আফ্রিকা, এশিয়া, এবং লাতিন আমেরিকায় রাষ্ট্রীয় এবং সামরিক সহায়তা প্রদান, যাতে কমিউনিজমের বিস্তার রোধ করা যায়।
- স্পেস রেস (1957-1969): মহাকাশে প্রযুক্তির দখল নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম স্যাটেলাইট “স্পুটনিক” পাঠায়, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের “আপোলো ১১” মিশন চাঁদে অবতরণ।
৫. ঠান্ডা যুদ্ধের সমাপ্তি (1989-1991):
- প্রাচ্য ও পশ্চিমের বিভাজন: সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট শাসনের পতন, যেমন পোল্যান্ডে সলিডারিটি আন্দোলন, এবং বার্লিন প্রাচীরের পতন (1989)।
- গরবাচভের সংস্কার: সোভিয়েত নেতা মিখাইল গরবাচভের “পেরেস্ত্রইকা” (আর্থ-সামাজিক সংস্কার) এবং “গ্লাসনোস্ত” (খোলামেলা যোগাযোগ) উদ্যোগ, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের দিকে নিয়ে যায়।
- সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন (1991): সোভিয়েত ইউনিয়ন ধ্বংস হয়ে রাশিয়া ও অন্যান্য প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করে।
৬. ঠান্ডা যুদ্ধের পরবর্তী প্রভাব:
- একক মহাশক্তি হিসেবে আমেরিকা: ঠান্ডা যুদ্ধের পর, আমেরিকা একক বিশ্বশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
- নতুন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: নতুন শক্তির কেন্দ্র তৈরি হয় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিলতা বেড়ে যায়। বহু দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে কিছু দেশ এখনও সোভিয়েত কমিউনিজমের প্রভাব অনুভব করছে।
উপসংহার:
ঠান্ডা যুদ্ধের সময় বিশ্ব দুই শিবিরে বিভক্ত ছিল, যার মধ্যে শক্তির প্রতিযোগিতা, পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার এবং গ্লোবাল রাজনৈতিক আন্দোলন প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। এটি শেষ হওয়ার পর, বিশ্বে অনেক পরিবর্তন এসেছে, তবে ঠান্ডা যুদ্ধের প্রভাব আজও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়।