পালরাজা প্রথম মহীপালের (983 C.E.) ষষ্ঠ রাজ্যাঙ্ক তালপাতার উপরে চিত্র সম্বলিত বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘অষ্টসাহত্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতা’, পান্ডুলিপির বারোটি রঙিন চিত্র বঙ্গীয় চিত্রকলার প্রাচীনতম নির্দশন। বর্তমানে এই দুর্লভ পান্ডুলিপি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে সংরক্ষিত আছে। এ ছাড়া প্রথম মহীপালের রাজত্বের আরও দুটি পান্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে, তবে এগুলি পরবর্তী সময়ের। পরবর্তী দুশো বছরে চিত্রসংবলিত আরও বেশকিছু পান্ডুলিপি পাওয়া যায়। যেহেতু পালবংশীয় রাজাদের রাজত্বকালে এ সমস্ত পান্ডুলিপি চিত্রালংকৃত হয়েছে, তাই এগুলিকে ‘পাল মিনিয়েচার’ বলে অভিহিত করা হয়।
পালযুগের চিত্ররীতি গড়ে উঠেছিল পৃথিচিত্রকে আশ্রয় করে। দেয়ালচিত্র বা ভিত্তিচিত্র হয়তো একেবারে অজ্ঞাত ছিল না। কিন্তু এ সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য নেই। প্রাক্-প্রথম মহীপালের পর্বের কোনো পুথি পাওয়া যায় না। ফলে পালযুগের দুশো বছরের অধিক অদিপর্বের চিত্ররীতির সঙ্গে আমাদের কোনো প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটেনি। তবে এই পর্বের চিত্রকলার গুপ্ত মার্গরীতির যে ঘনিষ্ঠ প্রভাব ছিল সে সম্পর্কে বোধ হয় কোনো সন্দেহ নেই। প্রথম মহীপালদের সময় থেকে রামপালের কাল পর্যন্ত পুথিচিত্রে মার্গরীতির আদর্শও মানস পরিস্ফুট।
আশ্চর্যের বিষয় হল যে, পাল আমলের বিপুল সংখ্যক-চিত্রালংকৃত পান্ডুলিপি হাজার বছর পরেও কালের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পেয়েছে। এ বিষয় থেকে পাল আমলে শিল্পের ব্যাপক প্রসার সমন্ধে ধারণা করা যায়। পাথর ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন মূর্তি সেই সময়ের শিল্পকলার প্রসারের কথাই ইঙ্গিত করে। পাল আমলের পান্ডুলিপিসমূহে যে বিপুল সংখ্যক মুদ্রাকৃতির চিত্র অঙ্কিত হয়েছিল তা অনুমান করা যায় তারিখযুক্ত পান্ডুলিপি থেকে। এ সময়ের তিনশোরও বেশি চিত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ছাড়া সেই সময়ের তৈরি তারিখবিহীন পান্ডুলিপির চিত্র সংখ্যা যোগ করলে এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে।
পালযুগের পান্ডুলিপিসমূহ উচ্চমানের তালপাতার উপর অনুলিখিত ও চিত্রালংকৃত করা হত। চিত্রাঙ্কন পদ্ধতিটি বেশ জটিল ছিল। তবে প্রাচীর চিত্রের তুলনায় পান্ডুলিপি। চিত্রের অঙ্কন কৌশল অনেক সহজ ও সরল ছিল। পাল চিত্রকলার রীতি চরিত্র নির্ধারণ করতে গিয়ে তিব্বতি ঐতিহাসিক লামা তারানাথ-এর বিবরণী উল্লেখযোগ্য। তাঁর মতে, পাল শাসক ধর্মপাল (781-821 C.E.) ও দেবপালের (821-861 C.E.) রাজত্বকালে পাল শিল্পকলা উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছিল। এসময় বরেন্দ্র বা উত্তরবঙ্গের দুজন শিল্পী ধীমান ও তাঁর পুত্র বীতপাল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পাথর ও ধাতুর ভাস্কর্য গড়ায় এবং চিত্রাঙ্কনে তাঁরা ছিলেন খুবই খ্যাতিমান শিল্পী। কিন্তু শিল্পরীতির ক্ষেত্রে পিতা-পুত্রের মধ্যে পার্থক্য ছিল।
স্থাপত্য ও ভাস্কর্য (লৌকিক স্থাপত্য): পালপর্বের লৌকিক স্থাপত্যের নিদর্শন। বিধৃত আছে সমকালীন মৃৎ ও প্রস্তর ফলকে উৎকীর্ণ ছবিতে। ক্ষণস্থায়ী উপাদানে তৈরি হত বলে এ ধরনের বাড়িঘরের অবশেষ বড়ো একটা চোখে পড়ে না। বাসগৃহ সাধারণত নির্মিত হত খড়, কাঠ ও বাঁশের মতো ভঙ্গুর উপকরণে। পালপর্বে লোকেদের বসবাসের জন্য এসব উপকরণ দিয়েই গৃহগুলি নির্মিত হত। দ্বিতল, ত্রিতল গৃহও একই রীতিতে তৈরি হত। উপরের চাল বিন্যস্ত হত ক্রমহ্রাসমান অনুকাকৃতি রেখায়। ধনী পরিবারের গৃহগুলি ছিল আয়তনে বড়ো এবং অলংকরণে সুসজ্জিত।কখনো-কখনো ইট দিয়েও বাড়িঘর তৈরি করা হত। তবে এ কথা স্বীকার করয়ে হবে, বিত্তবান, স্বল্পবিত্ত, ধনসম্পত্তি নির্বিশেষে সর্বসাধারণের ইট বা অনা কোনো স্থায়ী উপকরণের সাহায্যে বাসগৃহ নির্মাণে এক প্রকার অনীহা ছিল।
ধর্মগত স্থাপত্য: পালযুগে ধর্মগত স্থাপত্যকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যায়, যথা- রূপ, বিহার ও মন্দির।
■ ভূগ: রাজশাহি জেলার পাহাড়পুর, বাঁকুড়া জেলার বহুলাড়া এবং বর্ধমান জেলার পানাগড়ের নিকটবর্তী ভরতপুর গ্রামে দশম-একাদশ-দ্বাদশ শতকের কয়েকটি স্তূপের ভগ্নাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলি হল নিবেদন স্তূপ। ভক্তরা নিবেদনরূপে স্তূপগুলি নির্মাণ করে তাদের ভক্তি প্রকাশ করে গেছেন স্তূপগুলি আকারে মুদ্রাকার। এই স্তূপগুলির গর্ভ থেকে বৌদ্ধসূত্র উৎকীর্ণ অনেক মৃন্ময় সিলমোহর পাওয়া গেছে। তখনকার দিনে বৌদ্ধভিক্ষুরা এই সূত্রগুলিকে ধর্মশরীর মনে করতেন।
বিহার: পাল যুগে অনেক বিহার নির্মিত হয়েছিল। ভাগলপুর জেলার আন্টিচকে গঙ্গাতীরে ধর্মপাল বিক্রমশীলা বিহার নির্মাণ করেন। রাজশাহি জেলার পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার ধর্মপালের আর এক কীর্তি। এসময়ে একটি বিখ্যাত বিহার ছিল ওদন্তপুরী, কিন্তু এ বিহারটির নির্মাতা গোপাল, ধর্মপাল, না দেবপাল, তা নিশ্চিত * জনা যায় না। এ বিহারগুলি নিছক ভিক্ষুদের আবাসস্থলই ছিল না, তখনকার দিনে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রও ছিল।
মন্দির-স্থাপত্য: পালযুগে নির্মিত মন্দিরসমূহের মধ্যে পাহাড়পুরের বৃহদায়তন ও বহুতল মন্দিরটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই মন্দিরের সিংহভাগ ধর্মপালের রাজত্বকালে নির্মিত হয়েছিল বলে অনুমিত হয়। মন্দিরটি সোমপুর বিহার প্রস্থানে অবস্থিত। উত্তর-দক্ষিণে মন্দিরটি 107.6 মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে 95.77 মিটার পোড়ামাটির ইট ও কাদা গাঁথুনিতে তৈরি এই মন্দিরটি চতুর্বিংশতি কোণ। অর্থাৎ মূল চতুষ্কোণের প্রতিটি বাহু সম্মুখ দিকে তিনটি স্তর বা পর্যায়ে বিস্তৃত করে এক-এক দিকে ছ-টি থাকরে কোণ রচিত হয়েছিল। মন্দিরের প্রতিটি দিকে ছিল একটি করে পূজাস্থান।
কানায় পাহাড়পুরের মন্দিরের স্থাপত্যরীতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। ঐতিহাসিক কাশীনাথ দীক্ষিত মনে করেন, এই মন্দির নির্মাণে এক প্রাণস্বতন্ত্রশৈলী অনুসৃত হয়েছে। ভারতের অন্য কোথাও পূর্বে বা পরে এই রীতিতে ক্রাকোনো মন্দির নির্মিত হয়নি। ঐতিহাসিক সরসীকুমার সরস্বতী অবশ্য মনে করেন, ভারতীয় বাস্তুবিদ্যায় স্বীকৃত সর্বতো-ভদ্র রীতিতে পাহাড়পুর মন্দির নির্মিত।
ভাস্কর্য-কলা: পালপর্বের ভাস্কর্য শিল্পের নিদর্শন সুপ্রচুর। এ যুগের প্রতিমা তৈরি সইয়েছে বিভিন্ন উপাদানে। কোনো মূর্তি সূক্ষ্ম বা অপেক্ষাকৃত মোটাদানার কষ্টিপাথরে নির্মিত, কোনো মূর্তি পিতল বা মিশ্রধাতুতে গঠিত, কোনো মূর্তি সোনা বা রূপোর মতো মূল্যবান ধাতুতে গড়া, আবার কোনোটি বা দারুমূর্তি। মূর্তিগুলি সাধারণত স্থানক বা দণ্ডায়মান এবং আসন বা উপবিষ্ট ভঙ্গিমায় উপস্থাপিত। স্থানক ভঙ্গির আবার বিভিন্ন রূপ পরিলক্ষিত হয়-সমপদস্থান, আভঙ্গ, ত্রিভঙ্গ এবং অতিভঙ্গ।
পালযুগের প্রথম পর্বের অর্থাৎ খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের ভাস্কর্যের নিদর্শনাদি মূলত বিধৃত রয়েছে পাহাড়পুর মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তরের কোণের কুলুজিতে। কষ্টিপাথরের তৈরি এই স্মৃতিগুলির মধ্যে অনেকগুলিই কৃয়ের বাল্যলীলা বিষয়ক।
পালযুগের প্রতিমাকলা নিরীক্ষণ করলে বোঝা যায়, এ যুগের শিল্পভাবনার দুটি পরস্পরবিরোধী ধারণা কাজ করেছিল। একদিকে শিল্পী যেমন ইহগত দৈহিক, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কামনা-বাসনার সত্য প্রকাশ আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, অন্যদিকে তেমনি নৈর্ব্যক্তিক, অতিন্দ্রীয় ধ্যানধারণার রূপায়ণে সচেষ্ট থেকেছেন।