দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মার্ক্সীয় তত্ত্ব সমালোচনামূলকভাবে আলোচনা করুন। Discuss critically the Marxian theory of Dialectical Materialism.

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মার্ক্সীয় তত্ত্ব

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism) হলো এক ধরনের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি যা মূলত কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলসের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই তত্ত্বের মূল বক্তব্য হলো, সমাজের উন্নতি এবং পরিবর্তন প্রধানত অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে সংঘটিত দ্বান্দ্বিক সংঘর্ষের ফলস্বরূপ ঘটে। অর্থাৎ, ইতিহাসের বিকাশ এবং মানুষের চিন্তা-ভাবনা মূলত বস্তুগত বাস্তবতার, বিশেষ করে উৎপাদন সম্পর্কের দ্বারা প্রভাবিত এবং নির্ধারিত হয়। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের তত্ত্বের মূল ভিত্তি হল ‘বস্তুবাদ’ (Materialism) এবং ‘দ্বান্দ্বিকতা’ (Dialectics)।

১. বস্তুবাদ (Materialism)

মার্কসীয় বস্তুবাদ অনুযায়ী, বাস্তবতা হলো বস্তুগত—অর্থাৎ, জগতের মূল উপাদান হলো বস্তু, এবং সমাজের পরিবর্তন ও ইতিহাসের বিকাশ মূলত অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর নির্ভর করে। বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং আইডিওলজি, সবই বস্তুর পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক কাঠামো দ্বারা প্রভাবিত। এটি মোটামুটি ইংরেজ দার্শনিক থমাস হপসের “মানুষের মন এবং চিন্তা বস্তুগত বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত” ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

২. দ্বান্দ্বিকতা (Dialectics)

দ্বান্দ্বিকতা হলো পৃথিবীর অবস্থা ও প্রকৃতির মধ্যে সংঘর্ষ, বিরোধিতা এবং সেগুলোর সমাধান নিয়ে কাজ করা একটি দার্শনিক প্রক্রিয়া। মার্কসীয় দ্বান্দ্বিকতা হেগেলীয় দ্বান্দ্বিকতার প্রভাব গ্রহণ করে, তবে মার্কস দ্বান্দ্বিকতার ভিত্তি হিসাবে চিন্তাভাবনা বা আইডিয়াকে নয়, বস্তুগত বাস্তবতাকে (অর্থনৈতিক সম্পর্ক, শ্রেণীসংগ্রাম, প্রাকৃতিক পরিবেশ) ব্যবহার করেছেন।

বস্তুগত বাস্তবতার পরিবর্তন, উত্থান-পতন, এবং সংঘর্ষের মাধ্যমে সমাজের পরিবর্তন ঘটে। এই দ্বান্দ্বিক প্রকৃয়া ধাপে ধাপে তিনটি পর্যায় ধরে থাকে:

  • থিসিস (Thesis): একটি অবস্থান বা অবস্থা।
  • অ্যান্টিথিসিস (Antithesis): সেই অবস্থার বিপরীত অবস্থান বা বিরোধিতা।
  • সিনথিসিস (Synthesis): থিসিস এবং অ্যান্টিথিসিসের মধ্যে সংঘর্ষের পর একটি নতুন অবস্থার উদ্ভব।

৩. সামাজিক কাঠামো ও শ্রেণীসংগ্রাম

মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল শ্রেণীসংগ্রামের ধারণা। মার্কস বিশ্বাস করতেন যে, সমাজের ইতিহাস শুধুমাত্র অর্থনৈতিক শ্রেণীসমূহের দ্বন্দ্বের ইতিহাস। শ্রমিক শ্রেণী (প্রোলেটেরিয়েত) এবং পুঁজিপতি শ্রেণী (বুর্জোয়া) একে অপরের সঙ্গে বিরোধী সম্পর্কের মধ্যে থাকে, এবং এই দ্বন্দ্বের ফলস্বরূপ সমাজ পরিবর্তিত হয়। এটি একটি ইতিহাসগত প্রক্রিয়া, যেখানে শ্রেণীসংগ্রামের মাধ্যমে সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি পরিবর্তিত হয় এবং নতুন সামাজিক কাঠামো গড়ে ওঠে।

৪. মার্কসীয় তত্ত্বের সমালোচনা:

  • বিশ্বস্ততার অভাব: অনেক সমালোচক মনে করেন যে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ অত্যন্ত কঠিন এবং নির্দিষ্ট অনুমান ভিত্তিক। এটি খুব সাধারণীকৃত হতে পারে, যা পৃথিবী এবং মানুষের সমাজের বহুবিধ বৈচিত্র্যকে যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারে না।
  • পূর্বাভাস নির্ভরতা: মার্কসীয় তত্ত্বে ভবিষ্যতের সমাজের সঠিক পূর্বাভাসের কিছু চেষ্টা রয়েছে (যেমন সমাজতন্ত্রের উত্থান) যা বাস্তবে সঠিকভাবে প্রমাণিত হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে, এটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সঠিক বাস্তবতার সাথে মেলে না।
  • প্রাকৃতিক বৈশ্বিকতা অবহেলা: কিছু সমালোচক বলছেন যে, মার্কসীয় তত্ত্ব শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের দিকে মনোযোগ দিয়েছে এবং প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত সমস্যাগুলিকে গুরুত্ব দেয়নি। বর্তমান পরিবেশগত সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সময়ে এই দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা অপর্যাপ্ত মনে হতে পারে।
  • মানবিক দৃষ্টিকোণ: মার্কসীয় তত্ত্ব সমাজের পরিবর্তনকে মূলত অর্থনৈতিক শ্রেণীসংগ্রাম এবং দ্বান্দ্বিকতার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে, কিন্তু এটি মানুষের মনস্তত্ত্ব, সংস্কৃতি এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় না।

উপসংহার:

মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ একটি শক্তিশালী দার্শনিক কাঠামো যা সমাজ, অর্থনীতি এবং ইতিহাসের পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। যদিও এটি ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব, তার কিছু দিক সমালোচিত হয়েছে, এবং আধুনিক সমাজে বিভিন্ন অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এর আপেক্ষিকতা নিয়ে আলোচনা রয়েছে।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading