দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত রাশিয়া কীভাবে সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট গঠনের মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত রাশিয়া কীভাবে সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট গঠনের মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন, যা তখন একটি বৃহত্তম শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, পূর্ব ইউরোপে তার প্রভাব বিস্তার এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট গঠন করে। এই প্রক্রিয়া ছিল একটি বৃহত্তর কৌশল, যার মাধ্যমে সোভিয়েত রাশিয়া পশ্চিমী শক্তি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রাচীর তৈরি করতে চেয়েছিল এবং একটি ‘কমিউনিস্ট ব্লক’ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিল। এই সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট গঠনের পেছনে সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল উদ্দেশ্য ছিল তার প্রভাবিত অঞ্চলে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা করা, পশ্চিমী গণতন্ত্রের বিপরীতে একটি শাসনতন্ত্রের বিকাশ ঘটানো, এবং পরবর্তীকালে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের আদর্শকে সমগ্র বিশ্বের মধ্যে প্রসারিত করা।

এই প্রসঙ্গে, সোভিয়েত রাশিয়ার দ্বারা গঠিত সামরিক এবং অর্থনৈতিক জোটগুলি, বিশেষ করে ওয়ারশা প্যাক্ট এবং COMECON (Council for Mutual Economic Assistance) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

১. সামরিক নিয়ন্ত্রণ ও “ওয়ারশা প্যাক্ট” গঠন:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, সোভিয়েত ইউনিয়ন পশ্চিম ইউরোপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো (NATO) গঠনের বিরুদ্ধে একটি পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চেয়েছিল। ১৯৪৯ সালে ন্যাটো গঠন করা হয়েছিল, যা মূলত পশ্চিমী সামরিক শক্তির একটি জোট হিসেবে তৈরি হয়েছিল। এর পর, সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপে তার প্রভাব জোরদার করতে এবং একটি সামরিক জোট গঠনের উদ্দেশ্যে ওয়ারশা প্যাক্ট প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১৯৫৫ সালে গঠিত এই সামরিক জোটের সদস্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট দেশগুলি—পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, আলবানিয়া এবং পূর্ব জার্মানি।

ওয়ারশা প্যাক্টের মূল উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমী দেশগুলির সামরিক চাপের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সোভিয়েত ইউনিয়ন এই জোটের মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সামরিক উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলির উপর সরাসরি প্রভাব বিস্তার করেছিল। ওয়ারশা প্যাক্টটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য একটি সমর্থনকারী মঞ্চ, যার মাধ্যমে তারা পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট শাসনকে শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়।

ওয়ারশা প্যাক্টের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এটি পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকে সোভিয়েত সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়, যেমন ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত মিলিটারি হস্তক্ষেপ এবং ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় প্রাগ বসন্ত দমন। সোভিয়েত ইউনিয়ন, এই সামরিক জোটের মাধ্যমে, একে অপরকে সহযোগিতা এবং প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি, কমিউনিস্ট শাসন এবং আদর্শকে পূর্ব ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত করে।

২. আর্থিক অর্থনৈতিক প্রভাব এবং “COMECON” গঠন:

সামরিক শক্তির পাশাপাশি, সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অর্থনৈতিক প্রভাবও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য, ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন COMECON (Council for Mutual Economic Assistance) গঠন করে, যার মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট দেশগুলোকে একত্রিত করে একটি যৌথ অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা হয়। COMECON মূলত অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য সহজতর করার জন্য গঠন করা হয়েছিল, যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং নিজেদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করতে পারে।

COMECON-এর মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকে তাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের কেন্দ্রিকভাবে পরিচালিত করতে শুরু করে, যার ফলে তারা পশ্চিমী অর্থনৈতিক ব্লকের সাথে তেমন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন এর মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং সেই ব্যবস্থা অনুযায়ী ব্যবসা ও শিল্পের উন্নয়ন ঘটিয়েছিল।

৩. কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ:

সোভিয়েত রাশিয়া শুধু সামরিক এবং অর্থনৈতিক জোটের মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেনি, বরং রাজনৈতিকভাবে এই দেশগুলিকে একদম নিজের হাতে নিয়ে আসার জন্যও নানা কৌশল গ্রহণ করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল, যার জন্য তারা বিভিন্ন দেশীয় বিপ্লবী গোষ্ঠীকে সাহায্য এবং সমর্থন দেয়।

উদাহরণস্বরূপ, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, এবং পূর্ব জার্মানিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ এবং রাজনৈতিক চাপের মাধ্যমে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দেশের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের উপস্থাপন করেছিল, যা তাদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে দীর্ঘমেয়াদীভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সহায়ক ছিল।

এছাড়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন এসব দেশগুলির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত হস্তক্ষেপ এবং ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় প্রাগ বসন্ত দমন, সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের উদাহরণ হিসেবে দাঁড়ায়।

৪. পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব প্রতিক্রিয়া:

পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের এই সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব, কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা এবং জোট গঠনের মাধ্যমে ক্রমাগত একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ও সামরিক ব্লক তৈরি হয়েছিল, যা পশ্চিম ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শীতল যুদ্ধের এক মৌলিক অংশ হয়ে ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই কার্যক্রমের ফলে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা কমে গিয়েছিল, এবং সোভিয়েত আদর্শের প্রচারের জন্য এক ধরনের “আইron curtain” তৈরি হয়েছিল, যা পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম ইউরোপকে আলাদা করেছিল।

পূর্ব ইউরোপের জনগণের মধ্যে এই জোট এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থান ঘটে, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের সামরিক শক্তির মাধ্যমে এই আন্দোলনগুলো দমন করে। বিশেষ করে হাঙ্গেরি (১৯৫৬) এবং চেকোস্লোভাকিয়া (১৯৬৮)-এর ঘটনা সোভিয়েত সামরিক হস্তক্ষেপের প্রতিফলন।

উপসংহার:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট গঠনের মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই প্রক্রিয়া ছিল একটি গভীর রাজনৈতিক কৌশল, যার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার শাসনতন্ত্রকে সমগ্র পূর্ব ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কৌশলগুলির সংমিশ্রণ সোভিয়েত ইউনিয়নকে পূর্ব ইউরোপে দীর্ঘ সময় ধরে একটি শক্তিশালী প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছিল, যা পরবর্তী দশকগুলোতে শীতল যুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে আবির্ভূত হয়।

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading