অথবা, ভারতের নব্যপ্রস্তর যুগের সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
নব্যপ্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য:
নব্যপ্রস্তর যুগে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মানুষজন কৃষির আবিষ্কার করে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটায়। কৃষির আবিষ্কার থেকে নাগরিক সভ্যতার উদয় পর্যন্ত সময়কে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ ‘নব্যপ্রস্তর যুগ’ নাম দিয়েছেন।
সময়সীমা:
বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে নব্যপ্রস্তর যুগের সূচনা 9000 খ্রিস্টপূর্বাব্দে হলেও ভারতে মোটামুটিভাবে খ্রিস্টপূর্ব 6000 থেকে খ্রিস্টপূর্ব 2000 অব্দ পর্যন্ত এই যুগ বিরাজ করেছিল। তবে ভারতের সমস্ত জায়গায় এই সংস্কৃতি একই সময়ে আসেনি এবং সর্বত্র এই সংস্কৃতির অগ্রগতি একই হারে হ্যানি।
প্ররক্ষেত্র
নব্যপ্রস্তর যুগের সভ্যতার চিহ্ন ভারতের প্রায় সর্বত্র কমবেশি পাওয়া গেলেও মূলত সিন্ধু, বালুচিস্তান, দাক্ষিণাত্য, বিহার, ওড়িশা ও অসম প্রভৃতি জায়গায় পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বালুচিস্তানে মেহেরগড়, কিলিগুল মহম্মদ ও দাসব সাদাত, কাশ্মীরে বুজাহোম, বিহারের চিরাদ, অসমে দেওজালি হাডিং, অস্ত্রপ্রদেশের পিকালিহাল, কর্ণাটকের হাদুর, তামিলনাড়ুর পৈয়নপল্লিতে নব্যপ্রস্তর যুগের প্রচুর নিদর্শন পাওয়া গেছে।
হাতিয়ার ও অস্ত্রশস্ত্র:
নব্যপ্রস্তর যুগের সব হাতিয়ার ছিল কালো শ্লেট বা বেলেপাথরের তৈরি এবং সেগুলি অদ্ভুত রকমের মসৃণ ও পালিশ করা ছিল। এই মসৃণতা পাথরের অস্ত্রে আগে দেখা যায়নি। আর শুধু মসৃণতাই নয়, এগুলি ছিল আগের যুগের তুলনায় অনেক বেশি উন্নত। এই ছাড়া এ যুগের প্রত্নকেন্দ্র থেকে হাড়ের তৈরি অস্ত্র, যেমন-ছুঁচ, হারপুন, বর্শাফলক, তিরফলক, ছোরা প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যাওয়ায় বোঝা যায় যে, এই যুগে হাড়ের তৈরি অস্ত্রের ব্যবহার বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। অনেক সময় অস্ত্রগুলিতে হাতল লাগানো হত। এই যুগে তামার নিদর্শন পাওয়া গেলেও মানুষ তখনও ধাতুর ব্যবহার তেমন জানত না।
জীবিকা:
নব্যপ্রস্তর যুগে জীবিকা হিসেবে কৃষি ও পশুপালন আরও বেশি উন্নত হয়েছিল। এই যুগে মানুষ জমি চাষ করে ফসল উৎপাদন করতে শুরু করে। পাথরের ফলায় মাটি খুঁড়ে তাতে বীজবপণ করা হত। ধান, গম, বার্লি, যব ও ডাল উৎপন্ন হতে থাকে। এই যুগে তুলোর চাষও শুরু হয়। গৃহপালিত পশুর মধ্যে ছিল গোরু ও ছাগল। চাষ-আবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আগুনের ব্যবহারও শুরু হয়। প্রথমে হাতে এবং পরে ‘কুমোরের চাক’-এ তৈরি মৃৎপাত্রের ব্যবহার করার প্রচলন হয়। বালুচিস্তানের ঝোব, নাল, কুল্লি অঞ্চলে এই যুগের মৃৎশিল্পের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই যুগের মানুষ তুলো ও পশম দিয়ে বস্ত্রবয়ন শুরু করে। পাশাপাশি আরও অন্যান্য কিছু পেশা, যেমন-গৃহনির্মাণ, জাহাজ বা নৌকো তৈরি, মৃৎশিল্প প্রভৃতি সমাজে চালু হয়।
বাসস্থান:
এই যুগে মানুষ যাযাবর জীবন ত্যাগ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। তারা গৃহনির্মাণ করে বসতি গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়। তারা চালাঘরের দেওয়ালগুলি কাঁচামাটি বা পাথর দিয়ে তৈরি করত। কখনো-কখনো তারা তাঁবু খাটিয়ে বসবাস করত, যার নিদর্শন পাওয়া গেছে পিকনিহালে।
সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য:
এই যুগের মানুষ গুহাগাত্রে নৃত্য ও শিকারের দৃশ্য অঙ্কন
লোম। এই মগে মানায় নৌকা তৈরি করত ও সমদ্রযাত্রা করত। এই যগে মতদেহ সমাধিস্থ বা কবর দেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। তিন-চারটি পাথর দাঁড় করিয়ে তার উপর একখন্ড পাথরের ছাদ দিয়ে কবর দেওয়া হত, একে বলা হয় ‘ডোলমেন’ পদ্ধতি। বালুচিস্তানের প্রাপ্ত মাতৃকা মূর্তি ও বিহারের চিরান্দ-এ প্রাপ্ত সর্প মূর্তি দেখে বোঝা যায় যে, এই যুগের মানুষ মাতৃকাদেবী ও সাপের পূজা করত।
মূল্যায়ন– পরিশেষে বলা যায়, নব্যপ্রস্তর যুগে কৃষি ও পশুপালনকে কেন্দ্র করে মানুষের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে যায়। স্থায়ীভাবে বসবাস করায় ধীরে ধীরে গ্রামীণ রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে ওঠে।