পারিবারিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা বনফুলের ‘নিমগাছ’ একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। গল্পের কেন্দ্রীয় সত্য ও লক্ষ্য এক বাস্তব গৃহবধূর জীবযন্ত্রণা ও অসীম শূন্যতার অসহায় বেদনা। গল্পের কোথাও এতটুকুও অতিশায়িতা নেই। এই ব্যঞ্জনায় ‘নিমগাছ’ গল্পে গাছ হল বধূর জীবনধর্মের প্রতীকপ্রীতম অস্তিত্ব! নিমগাছ আবর্জনার মধ্যে থাকলেও সে চরম চর্মরোগ সারানোর ওষুধ দেয়, খাদ্য হয় নানাভাবে, পরিবেশের বাতাস দিয়ে মানুষের সুস্থতা বজায় রাখার ব্যবস্থা করে। এসবই গৃহবধূর রূঢ় বাস্তব জীবনের সার্থক প্রতীক।
কবি নিমগাছের মধ্যে অনুভব করেছেন প্রকৃতির সৌন্দর্যরসসিক্ত অসীম অন্তরের মায়া! তা উদাসী বাউল স্বভাবের, কেবল এক ¯্রষ্টার অভিজ্ঞতায় মেলে। ‘নিমগাছ’ গল্পের কেন্দ্রীয় সত্য ও লক্ষ্য এক বাস্তব গৃহবধূর জীবনযন্ত্রণা ও অসীম শূন্যতার অসহায় বেদনা। গোটা গল্পে একমাত্র চরিত্র ওই গৃহবধূ। বনফুল যখন নিমগাছ গল্পটি লেখেন তখর সারা ভারত তথা বাংলাদেশে ছিল রক্ষণশীল একান্নবর্তী পরিবারিক জীবনব্যবস্থা। সেখানে কোন গৃহবধূর স্থান হত দাসীর মতো। অন্তত পাত্রপক্ষের বর বিবাহ করতে যাবার সময় মায়ের কাছে বলে যেত, সে যাচ্ছে দাসী আনতে। এই প্রথা-সংস্কারের গৃহবধূকে শ্বশুড় বাড়ির যাবতীয় কাজ সারাদিন রাত মুখ বুজে করে যেতে হত। বধূর কোনো স্বতন্ত্র সত্তার, ভালো-লাগা, মন্দ লাগার বিচার সংসারে গ্রাহ্য হত না।
এমন একটি বধূর মতোই রমণীর সঙ্গে বর্তমান গল্পে আমাদের পরিচয় ঘটে। তার আকাশ দেখার সময় থাকে না বুঝিবার অধিকারও ছিল না। ফুসরতও ছিল না। এই যে বধূর মুক্তি বাসনা, এক গভীর শূন্যতা থেকে মুক্তির, স্বাধীনতা ভোগের আর্তি, তা পরিপার্শ্বের নিরাসক্ত নিস্পৃহ আচরণের নিষ্ফল মাথা কুটে হৃদয় পাথরের ভারে রক্তাক্ত হয়ে থাকত। সে রক্ত তার অবহেলত জীবনের তাজা রক্তক্ষরণ। গল্পের নিমগাছ আসলে এমন এক গৃহকর্মনিপুণা লক্ষীমন্ত বধূর জীবন ও হৃদয়ের কঠিন প্রতীকঃ
‘নিমগাছটার ইচ্ছে হতে লাগল লোকটার সঙ্গে চলে যায়। কিন্তু পারলে না। মাটির ভিতর শিকড় অনেক
দূরে চলে গেছে। বাড়ির পিছনে আবর্জনার স্তুপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল সে।
এই যে বন্ধনের দশা, তা তার পারিবারিক জীবন ও পরিপাশ্বের দেওয়া নির্মম নিয়তি। বধূটি ঘরের সবরকম কাজে কৃতী, তার মধ্যেই তার জীবন সত্যকে একমাত্র ভাবে। বধূটি আবার লক্ষীর মতো শান্ত, ধীর, স্থির ও মঙ্গলদায়িনী। এরকম নারী তো প্রতিবাদী হয় না। এইভাবে জীবন কাটাতে কাটাতে সে সংসারের চরম নির্ভরতার জরুরী নিকেত হয়ে ওঠে।