পরবর্তী বৈদিক যুগের আর্য সভ্যতার :- পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্যদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক জীবনে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়।
-: পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্যদের সমাজে কি কি পরিবর্তন সেগুলো আলোচনা করা হল :-
সামাজিক অবস্থা :- এযুগেও ঋগৈ¦দিক যুগের মত সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি ছিল পরিবার। গৃহনির্মাণ বা পোশাকের ক্ষেত্রে এ যুগে তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি। খাদ্যের ক্ষেত্রে মাংসাহারকে ভাল চোখে দেখা হতো না। কিন্তু তখনও অতিথি আপ্যায়নে বা উৎসব উপলক্ষে গরু বা ছাগল হত্যা করা হতো। পানীয় হিসাবে আগের মত সোম ও সুরা ব্যবহার করা হতো। অবসর বিনোদনের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এ যুগে শৈলুষ বা অভিনেতা এবং গাঁথার উল্লেখ পাওয়া যায়। উৎসবাদিতে বীণাবাদকগণ গাঁথাগুলো গাইতেন।শততন্তু (শততন্ত্রী বিশিষ্ট) বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার এ যুগে সঙ্গীতের উৎকর্ষের পরিচায়ক। এ যুগের সমাজ ব্যবস্থায় দুটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। এ যুগে নারীর মর্যাদা অনেক হ্রাস পায়। পরবর্তী
বৈদিক সাহিত্যে কন্যার জন্মের জন্য শোক প্রকাশ এবং পুত্রের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। কন্যা সন্তানের
জন্মকে দুর্ভাগ্য বলে মনে করা হতো। এ যুগে বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহ বৃদ্ধি পায়। নারী সম্পত্তির
উত্তরাধিকার লাভের অধিকার হারায়।ধর্মাচারণে পুরোহিত শ্রেণীর আধিপত্য বৃদ্ধি পাওয়ায় নারীদের পুরুষের
সঙ্গে ধর্মাচারণের অধিকার কমে যায়। এ যুগেও গার্গী, মৈত্রেয়ী প্রভৃতি উচ্চশিক্ষিতা মহিলার কথা জানা
যায়। তবে সাধারণভাবে নারীর সামাজিক মর্যাদার যে অবনয়ন ঘটেছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এ যুগে পূর্বের পেশাভিত্তিক চারটি শ্রেণীর স্থলে বংশগত চারটি জাতির উদ্ভবের লক্ষণ দেখা দেয়। এক
শ্রেণীকে অন্য শ্রেণী থেকে আলাদা রাখার জন্য কঠোর নিয়ম প্রচলিত হয়। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় এ যুগে বৈশ্য ও
শূদ্র কন্যাকে বিয়ে করতে পারলেও এর বিপরীত ব্যাপারটি ছিল অসম্ভব। বর্ণ বা শ্রেণী পরিবর্তন অসম্ভব না
হলেও ছিল অত্যন্ত কঠিন। এ যুগে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং তাঁদের মধ্যে বিরোধেরও
সুত্রপাত হয়। তাঁরা এমন অনেক সুবিধা ভোগ করতেন যা বৈশ্য বা শূদ্রদের পক্ষে ভোগ করা সম্ভব ছিলনা।
সমাজ জীবনে যজ্ঞানুষ্ঠানের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় পুরোহিতদের মর্যাদাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। ব্রাহ্মণ নিজেকে
ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী এবং রাজ্যের রক্ষক বলে দাবী করতেন। ক্ষত্রিয়রা রাজকার্য ও যুদ্ধ করে
শক্তিশালী শ্রেণীতে পরিণত হয়। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ক্ষত্রিয়দের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলা হয়েছে এবং এ
যুগে অস্পৃশ্যতার সূচনা হয়। শূদ্রকে মনে করা হতো অপবিত্র এবং সে অগ্নিদেবতার উদ্দেশ্যে তৈরি নৈবেদ্য
স্পর্শও করতে পারতো না। একজন ছুতোর মিস্ত্রীর ছোঁয়াকে অশুচি বলে মনে করা হতো।
অর্থনৈতিক অবস্থা ঃ
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এ যুগে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। এ যুগেও বিত্তশালী ব্যক্তিসহ মানুষ
প্রধানত গ্রামেই বাস করতো। কিন্তু নাগরিক জীবনের সুযোগ-সুবিধা তাদের অজ্ঞাত ছিলনা। এ যুগে বেশ
কয়েকটি নগরের উদ্ভব ঘটে। শিল্প ও বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসাবে নগরের উদ্ভব ঘটে। গাঙ্গেয় উপত্যকায়
অর্থনীতিতে শ্রাবস্তি, চম্পা, রাজগৃহ, অযোধ্যা, কৌশাম্বী এবং কাশী যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন
করেছিল। মৃৎশিল্প, ছুতারগিরি, বয়নশিল্প ইত্যাদির মতো শিল্পে বিশেষজ্ঞতা অর্জনকারী গ্রাম ও ব্যবসা
কেন্দ্রগুলোকে কেন্দ্র করে নগরগুলোর উদ্ভব হয়। বিশেষজ্ঞ কারিগরদের মধ্যে একত্র জড় হওয়ার প্রবণতা
দেখা যায়। কারণ, এতে কাঁচামাল পরিবহন ও উৎপাদিত পণ্যের বিতরন সহজতর হয়। উদাহরণ হিসাবে
বলা যায় যে উপযুক্ত মানের কাঁদামাটির প্রাপ্যতা মৃৎশিল্পীদের বড় সংখ্যায় কোন একটি এলাকায় জড় হতে
উৎসাহিত করে। কাজেই কোন নগরে কারিগরদের শ্রেণীকরণ তাদেরকে ব্যবসায়ী ও বাজারের নিকটবর্তী
করে তোলে।
কৃষিক্ষেত্রে এ যুগে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়। উর্বর নদী-উপত্যকা দখল এবং দক্ষ কৃষিজীবি দ্রাবিড়
সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগের ফলেই সম্ভবত এটা হয়েছিল। এ যুগে কৃষিকাজে লোহার লাঙলের ব্যবহার
শুরু হয়। লোহার লাঙল টানার জন্য কখনও কখনও একসঙ্গে ২৪টি গরুর প্রয়োজন হত। কৃষির প্রয়োজনে
এ সময় মহিষকে পোষ মানানো হয়েছিল। কৃষিক্ষেত্রে জলসেচ পদ্ধতি ও সার প্রয়োগ প্রথার উন্নতি ঘটে।
শিম, তিল ইত্যাদি নতুন ফসল উৎপাদন শুরু হয়। শিলাবৃষ্টি, পঙ্গপাল, খরা অতিবৃষ্টি চাষের ক্ষতি করতো।
এ যুগের অর্থনীতিতে গরু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল। ফলে যজ্ঞের প্রয়োজন ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে
গো-হত্যা নিষিদ্ধ ছিল। এ যুগে যুদ্ধের প্রয়োজনে হাতিকে পোষ মানানো হয়।
এ যুগে জমির মালিক ছিল পরিবার।পরিবারের লোকেরাই জমি চাষ-আবাদ করতো। তবে এ সময় জমিদার
শ্রেণীর উদ্ভবের সাক্ষ্য পাওয়া যায়। তারা অনেক জমির মালিক হলেও নিজ হাতে চাষ-আবাদ করতোনা।
জমি হস্তান্তর সম্পর্কে কঠোর নিয়ম প্রণয়ন করা হয়।
পরবর্তী বৈদিক যুগে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। ব্যবসার কাজ অনেকক্ষেত্রে বংশানুক্রমিক হয়ে পড়ে।
কাপড়, ছাগলের চামড়া ও অন্যান্য পোশাকের দ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় হত। পূর্বে বিহার থেকে পশ্চিমে পাঞ্জাব
পর্যন্ত বাণিজ্য চলতো। কিরাত নামে এক উপজাতি ওষুধের বিনিময়ে বস্ত্র ও চামড়া নিতো। স্থলপথে রথ বা
গরুর গাড়ী এবং নদী পথে নৌকায় পণ্য বহন করা হতো। এ যুগে সমুদ্র আর্যদের কাছে অপরিচিত ছিলনা।
সে যুগে সম্ভবত মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। নিষ্ক, শতমান এবং কৃষ্ণল নামে মুদ্রার
প্রচলনের ফলে ব্যবসায়িক লেন-দেন কিছুটা সহজ হয়েছিল। তবে এ যুগেও এগুলো মুদ্রার সকল বৈশিষ্ট্য
অর্জন করেছিল কিনা সে সম্পর্কে পন্ডিতদের সন্দেহ আছে। বণিকরা সম্ভবত সংঘ গঠন করেছিল – ‘গণ’
এবং ‘শ্রেষ্ঠীর’ উল্লেখ থেকে এ ধারণা পাওয়া যায়।
শিল্পের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য এবং কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। এ যুগে একজন ছুতোর মিস্ত্রি এবং একজন রথ
নির্মাতার মধ্যে পার্থক্য ছিল যদিও দুজন কাঠের কাজ করতো। ধনুক যে তৈরি করতো সে ধনুকের ছিলা
তৈরি করতো না – সেটা ছিল অন্য একজন দক্ষ লোকের কাজ। পূর্বের সোনা, রূপা ও ব্রোঞ্জের সাথে এ
যুগে লোহা, সীসা এবং টিনের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। সে যুগে কর্মজীবনে মহিলাদেরও ভ‚মিকা ছিল। তারা
সূচি শিল্পে ও রঞ্জন শিল্পে অংশগ্রহণ করতো।
ধর্মীয় অবস্থা:
এ যুগে ধর্মের ক্ষেত্রেও আর্যদের জীবনে বেশ বড় পরিবর্তন দেখা যায়। যজ্ঞ আগের তুলনায় অনেক জটিল
ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যজ্ঞকে দেবতাদের ওপরে স্থান দেওয়া হয়। যজ্ঞের গুরুত্ব ও ব্যাপকতা বৃদ্ধি
পাওয়ায় এবং একমাত্র পুরোহিতই যজ্ঞ সম্পাদনে দক্ষ হওয়ায় এ যুগে সমাজে পুরোহিতদের সংখ্যা এবং
মর্যাদা বেড়েছিল। জটিলতার কারণে এখন একটি যজ্ঞে কয়েকজন পুরোহিতের প্রয়োজন হতো।
এ যুগে দেবদেবীর পারস্পরিক অবস্থান ও গুরুত্বেরও পরিবর্তন ঘটে। পরবর্তী বেদগুলোতে মাঝে মাঝে
ঋগৈ¦দিক দেবদেবী বরুণ এবং পৃথিবীর উদ্দেশ্যে রচিত স্তোত্র দেখা গেলেও এ যুগে প্রজাপতি সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ দেবতা হয়ে ওঠেন। তাঁকে সকল জীবের দেবতা রূপে গণ্য করা হতো। ঋগৈ¦দিক যুগের অন্য
দুজন দেবতা রুদ্র এবং বিষ্ণুও এ যুগে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেন। রুদ্র আগে শিবরূপে পরিচিত ছিলেন, এ
যুগে তিনি মহাদেব এবং পশুপতি নামে পরিচিত হন। বিষ্ণু এ যুগে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন এবং তাঁকে
মহাজাগতিক এবং নৈতিক বিন্যাসের উৎস, দুঃখে মানুষের মুক্তিদাতা এবং দেবতাদের ত্রাতারূপে গণ্য করা হয়।
এ যুগে শয়তান, জাদুমন্ত্র ইত্যাদি সম্পর্কে বিভিন্ন কুসংস্কার মানুষের মনে দেখা দেয়। এ যুগে ঋগে¦দের একেশ্বরবাদের ধারণা আরও স্পষ্ট হয়। এ যুগে অবতারবাদের ধারণার সূচনা হয়। এ যুগেই মানুষের মনে নানা ধরনের নতুন চিন্তা ও প্রশ্নের উদ্রেক হয়। যজ্ঞ এবং পশুবলির কার্যকারিতা সম্পর্কে তাদের মনে প্রশ্ন জাগে। এসবের কোনো কোনো প্রশ্ন সন্ন্যাসের জন্ম দেয়- মানুষ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সন্ন্যাসী হয়ে বা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে জনবসতি থেকে দূরে বাস করতে থাকে। মানুষের সন্ন্যাসব্রত গ্রহণের দুটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে- দৈহিক কৃচ্ছ্রসাধন ও ধ্যান দ্বারা রহস্যপূর্ণ শক্তি, জাদুবল অর্জন করা অথবা শারীরিকভাবে সমাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে সামাজিক আচার, বিধিনিষেধ থেকে মুক্তি লাভ করা।
রাজনৈতিক অবস্থা :-
পরবর্তী বৈদিক যুগে গঙ্গা-যমুনা গন্ডক উপত্যকায় আর্য বসতি বিস্তার লাভ করে। পূর্বমুখী এ আর্য সম্প্রসারণের একাধিক কারণ ছিল। পুরোহিতরা আরো বেশি ভ‚মিকে বৈদিক ধর্মের আওতায় আনতে চেয়েছিল। তাছাড়া শক্তিশালী উচ্চাকাক্সক্ষী রাজাদের রাজ্যজয়ও তাদের এ অঞ্চলে নিয়ে এসেছিল। এ যুগে পশ্চিমাঞ্চল গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে এবং মধ্যদেশ আর্যদের কর্মকান্ডের কেন্দ্রে পরিণত হয়। এ যুগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পরিবর্তন হচ্ছে রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি। ঋগৈ¦দিক যুগে আর্য উপজাতিগুলো নিজেদের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধে লিপ্ত হতো। ফলে সফল সামরিক রাজার অধীনে অনেক উপজাতির একত্রিকরণ ঘটতো এবং রাজ্যের আয়তনেরও বিস্তৃতি ঘটতো। অনার্যদের সঙ্গে যুদ্ধের ফলেও রাজ্যের আয়তনের বৃদ্ধি ঘটে। ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে রাজা এখন নিজেকে তাঁর প্রজাদের একচ্ছত্র প্রভুরূপে বিবেচনা করতে থাকেন। তিনি এখন প্রজাদের কাছ থেকে বলি, শুল্ক ও ভাগ নামক করও আদায় করতে থাকেন। তাঁর দায়িত্বের অবশ্য তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি-আগের মতই তাঁর প্রধান দায়িত্ব ছিল সামরিক ও বিচার বিষয়ক। তিনি ছিলেন প্রজাদের জানমালের রক্ষক এবং শত্রু ধ্বংসকারী। সফল ও শক্তিশালী রাজারা ‘রাজা বিশ্বজনীন’ , ‘সর্বভ‚মি’, ‘একরাট’ ইত্যাদি উপাধি গ্রহণ করেন এবং নিজ নিজ মর্যাদা অনুযায়ী ‘রাজসূয়’, ‘বাজপেয়’ এবং ‘অশ্বমেধ যজ্ঞ’ উদযাপন করতেন। রাজা সবসময় না হলেও, সাধারণত হতেন ক্ষত্রিয়। সাধারণত রাজপদ ছিল বংশানুক্রমিক যদিও মাঝে মধ্যে নির্বাচিত রাজার উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও নির্বাচন রাজপরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো।
এ যুগে রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলেও নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অভিষেকের সময় রাজাকে সিংহাসন থেকে নেমে এসে ব্রাহ্মণদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হতো। এ সময় তিনি ব্রাহ্মণ ও গোধনকে রক্ষা এবং জনহিতকর কাজ করার অঙ্গীকার করতেন। আগের তুলনায় সমিতির গুরুত্ব হ্রাস পেলেও এ যুগেও সভা তার গুরুত্ব বজায় রাখে। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে রাজার সমৃদ্ধির জন্য সভার সঙ্গে রাজার মতৈক্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
রাজক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শাসনযন্ত্রেরও সম্প্রসারণ ঘটে। ঋগৈ¦দিক আমলে পুরোহিত, সেনানী ছাড়া তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য রাজকর্মচারীর উল্লেখ দেখা যায়না।কিন্তু এ যুগে বহুসংখ্যক উচ্চপদস্থ বেসামরিক কর্মচারীর উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে সংগ্রহিত্রী (কোষাধ্যক্ষ), ভাগদুগ (কর আদায়কারী), সূত (রাজকীয় ঘোষক বা রথ চালক), ক্ষত্রী (রাজ সংসারের সরকার), অক্ষবাপ (জুয়া খেলার অধ্যক্ষ) এবং গো-বিকর্তন (শিকারের রাজসঙ্গী) বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ যুগে একাধিক সংগ্রহিত্রী ও ভাগদুগের অন্যদিকে বলি ও শুল্কের উল্লেখ থেকে ধারণা করা যায় যে কর ও রাজস্ব ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছিল। রাজপরিবারের সদস্য ও ব্রাহ্মণদের কোন কর দিতে হতো না। ‘স্থপতি’ ও ‘শতপতির’ উল্লেখ থেকে ধারণা করা যায় যে এ যুগে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল। সীমান্তবর্তী অঞ্চলের দায়িত্বে নিযুক্ত কর্মচারীকে বলা হতো স্থপতি। এ জাতীয় অঞ্চলের অধিবাসীরা সাধারণত ছিল অনার্য। শতপতির দায়িত্ব ছিল একশত গ্রামের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করা। বিচার ব্যবস্থায় রাজার বিশেষ ভ‚মিকা থাকলেও তিনি সব সময় নিজে বিচার না করে সে দায়িত্ব অধ্যক্ষদের ওপর অর্পণ করতেন।
উপসংহারঃ- আর্যরা খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের দিকে ভারতবর্ষে আগমন করে। ক্রমে তারা এখানে গড়ে তোলে আর্যসভ্যতা। আর্যদের ধর্মগ্রন্থ বেদ (পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থ) থেকে ভারতে তাদের জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে কিছু ধারণা লাভ করা যায়। বেদ চারভাগে বিভক্ত ঋক্, সাম, যজুর এবং অথর্ব। ঋগে¦দের সম্ভাব্য রচনাকাল ১৫০০-৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে এবং অন্য তিনটি ৯০০-৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে রচিত হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। বেদের রচনাকালের ওপর নির্ভর করে আর্যসভ্যতাকে দুভাগে ভাগ করা হয়Ñ ঋগৈ¦দিক যুগের সভ্যতা এবং পরবর্তী বৈদিক সভ্যতা। উভয় যুগের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ছিল বিধায় আর্যদের জীবনচর্চায় সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ঋগে¦দের যুগে পাঞ্জাব ছিল আর্যসভ্যতার কেন্দ্রভ‚মি। কালক্রমে তারা ভারতের পূর্বদিকে বসতি বিস্তার করে এবং মধ্যদেশ তাদের কর্মকান্ডের কেন্দ্রে পরিণত হয়। আমরা বলতে পারি, ঋগৈ¦দিক যুগে আর্য সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি, রাজনীতি ক্রমে সুস্পষ্ট রূপ পরিগ্রহণ শুরু করে, তবে পরবর্তী বৈদিক যুগে তা সুসংহত ও সুসংঘবদ্ধ হয়ে ওঠে।