পাল আমলে ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো। Write a note on the Religious condition during the Pala Period

বাংলায় দীর্ঘ পাল শাসনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল দিক হল তাদের প্রজা-বৎসল শাসননীতি। পাল সম্রাটগণ ছিলেন বৌদ্ধ, কিন্তু প্রজাদের অধিকাংশ ছিল হিন্দু। পাল সম্রাট ধর্মপাল ধর্মীয় সম্প্রীতির নীতি গ্রহণ করেছিলেন রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি সকল শাস্ত্র সমন্ধে জ্ঞাত এবং যাতে সব ধর্ম-বর্ণ তাদের কার্যকলাপ বজায় রাখতে পারে, সেদিকে তিনি তৎপর থাকবেন। প্রজাদের ধর্ম-কর্ম সম্পর্কে সচেতনার এই ঘোষণা দীর্ঘ পাল শাসন আমলে অনুসৃত হয়েছিল বলেই মনে হয়।

এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, পাল সম্রাটগণ বৌদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু দেবদেবী। বা ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় সম্রাটদের অকুণ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। রাজকীয় উচ্চপদ- সমূহে অধিষ্ঠিত দেখা যায় ব্রাহ্মণদের। ধর্মপালের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ এবং এই মন্ত্রী পরিবার তিন পুরুষ ধরে পাল রাজাদের শাসনের সঙ্গে জড়িত ছিল। রাজাদের যতগুলি ভূমিদান সংক্রান্ত তাম্রশাসন আজ পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে তার দু-একটি ছাড়া সবকটিতেই দান লাভ করেছে হিন্দু দেবদেবীর মন্দির বা ব্রাহ্মণ। পাল সম্রাট ধর্মপাল ভূমিদান করেছিলেন নারায়ণের উপসানার জন্য। 4

নারায়ণ পাল, প্রথম মহীপাল এবং নয়পাল পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন শৈব সন্ন্যাসীদের আর স্থাপন করেছিলেন শৈব মন্দির। সেগুলির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তাঁরা ভূমিদান করেছিলেন। প্রথম মহীপাল বারাণসীর পশুপত গুরু শ্রীবামরাশির ভক্ত ছিলেন এবং তার পায়ে আরাধা করতে বারাণসীতে গিয়েছিলেন। বাংলায় জনজীবনে হিন্দু-বৌদ্ধের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহাবস্থান পালযুগের সমাজজীবনে বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা যায় পালযুগের সিলমোহরগুলিতে সাধারণত ধর্মচক্র অঙ্কিত আছে। এই ধর্মচক্র ভগবান বুদ্ধদেবের সারনাথে সর্বপ্রথম ধর্মপ্রচারের প্রতীক। তাঁদের লেখমালার প্রারম্ভিক বন্দনা শ্লোকটিও ভগবান বুদ্ধদেবের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। তাঁরা প্রায়ই পরমসৌগত বলে নিজেদের -পরিচয় দিয়েছেন। সুগত বা বুদ্ধদেবের পরমভক্ত, এই অর্থে পরমসৌগত। বাংলা ও বিহারের নানা স্থানে নতুন নতুন বিহার নির্মাণ ও পুরোনো বিহারের সংস্কারসাধন করে তাঁরা বৌদ্ধধর্ম B সংস্কৃতির প্রতি তাঁদের অকুন্ঠ অনুরাগ প্রকাশ করে গেছেন। ধর্মপাল ভাগলপুরের নিকট গঙ্গাতীরবর্তী অপ্টিচকে বিক্রমশীল বিহার নির্মাণ করেন। রাজশাহি – জেলার পাহাড়পুরে সোমপুর বিহারেরও তিনি নির্মাতা।

পালরাজাদের ধর্মবিষয়ক গোঁড়ামি কিন্তু ছিল না। তাই বৌদ্ধ হয়েও অন্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের উৎসাহ কিছুমাত্র কম ছিল না। বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। পাল লেখনীতে অনেক ব্রাহ্মণ দেবদেবী ও পৌরাণিক কাহিনির বর্ণনা আছে। হিন্দু দেবদেবীর তুলনায় বৌদ্ধ দেবদেবী ও কাহিনির উল্লেখ অনেক কম। পাল রাজপ্রাসাদে মহাভারত পাঠের ব্যবস্থা ছিল। মদনপালের মহিষী চিত্রমতিকাকে মহাভারত পাঠ করে শোনাতেন ব্রাহ্মণ বটেশ্বরস্বামী।

কোনো-কোনো পালরাজা তো ব্রাহ্মণ্য ধর্মই গ্রহণ করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন নারায়ণ পাল এবং তাঁর অতিকনিষ্ঠ প্রপৌত্র নয়পাল। এঁরা সকলেই বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করে শৈবধর্ম অবলম্বন করেন। আসলে পালযুগে ধর্মীয় ক্ষেত্রে সমন্বয়ের সুর বেজে ওঠে। উভয়ের মধ্যে ব্যবধান সংকুচিত হয়ে ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধধর্ম পরস্পরের সন্নিকটবর্তী হয়। ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বীদের মতো বৌদ্ধদের অনেকেই মূর্তিপূজা, মন্ত্রপাঠ, আচার-অনুষ্ঠানে উৎসাহী হন। আবার তন্ত্রের প্রভাবে ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মের দেহবাদ বা নরনারী বা পুরুষ প্রকৃতির অতীন্দ্রিয় মিলন পরম জ্ঞানলাভের প্রকৃষ্ট উপায়রূপে গণ্য হয়। শক্তি রা প্রকৃতির সাধনা উভয় ধর্মেই প্রাধান্য পায়। বিস্তৃর যেমন লক্ষ্মী এবং শিবের মহামায়া, মোদি বৃদ্ধ-বজ্রসঙ্গের তেমনি প্রজ্ঞা-পারমিতা এবং ধ্যানী বুদ্ধ অমিতাক্ষেয় মামকা।

প্রাক্-পালপর্বে বাংলা-বিহারে মহাযান বৌদ্ধধর্ম প্রচলিত ছিল। কিন্তু পালযুগে এসব তাত্ত্বিক ধ্যানধারণা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। তত্ত্বগুলি পুরোপুরি বিদায় নিল না ঠিকই, কিন্তু তো স্বল্প সংখ্যক পণ্ডিত-সাধকদের চর্চা ও সাধনার মধ্যেই আবদ্ধ থাকল। পরিবর্তে মহাযান মুরীদ্ধধর্মে নতুন ধ্যান কল্পনা গড়ে উঠল। এর কারণও ছিল মহাযানদের পারমর্থিক তত্ত্ব ও সাধনমার্গের সাধারণ লোকেদের নিকট দুর্বোধ্য ছিল। স্বাভাবিক কারণে সমাজে এসব তাত্ব ও সাধনমার্গ সাধারণ লোকেদের কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠেছিল।

দীর্ঘ শাসনকালে এই সামাজিক সম্প্রীতি পালযুগকে অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নতিসাধনে অবশ্যই সাহায্য করেছিল। পাল সম্রাটদের প্রজাহিতৈষণার দৃষ্টান্ত রয়েছে। পাল সম্রাট মপাল বহু রৌপ্যমুদ্রা খরচ করে খনন করেছিল কয়েকটি দিঘি। বাংলার জনজীবনে ধর্মীয় সহিহ্বতার যে ঐতিহ্য পাল যুগে সৃষ্টি হয়েছিল সেনযুগে তা বিঘ্নিত হওয়ার ফলেই হয়তো পরবর্তীকালে বাংলার সমাজজীবনে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। বাংলার ধর্মজীবনে হিন্দু-বৌদ্ধ সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ও সমবায়ের যে সুদীর্ঘ ধারা পাল শাসনামলে সূচিত হয়েছিল, সৃষ্টি হয়েছিল সহজিয়া ও তান্ত্রিক মতাদর্শের, তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব বাংলার জনজীবনে পরিলক্ষিত হয় মধ্যযুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগেও

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading