পাল সাম্রাজ্যের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর একটি টীকা লেখো। Write a note the socio-economic conditions of the Pala Empire.

পাল আমলে যেসব জাতির নাম পাওয়া যায় সেগুলি হল- কিরাত, নিষাদ, দামিল, পুণ্ড্র। দামিল ও নিষাদ জাতির লোকেরা কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত। অনুমান করা হয় যে, পালযুগের বাংলার জনগণ তথা এসব জাতিসমূহ এক উন্নত সভ্যতা ও সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।

পাল সাম্রাজ্যের  জাতিভেদ: প্রাচীন যুগে আর্যদের আগমনের পরপরই জাতিভেদ প্রথার প্রচলন হয়। সমাজের কিছু অংশ বর্ণ কাঠামোর অন্তর্ভূক্ত ছিল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র-এই চারটি ভাগে সমাজ বিভক্ত ছিল। ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব সর্বত্র স্বীকৃত। তাঁরা তীর্থভ্রমণ করেন, বেদজ্ঞ, শাস্ত্রবিদ, পূজা, যজ্ঞ, আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। ক্ষত্রিয়রা যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকত। বৈশ্যরা পশুপালন ব্যাবসাবাণিজ্য, চাষা-আবাদ করত এবং শূদ্ররা এই তিন শ্রেণিকে সেবা করত।

পালযুগের লেখগুলিতে ব্রাহ্মণদের তুলনায় ক্ষত্রিয়দের উল্লেখ কম। তবে ক্ষত্রিয়দের যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল। সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’ গ্রন্থে রামপালের ক্ষত্রিয়েত্বের দাবি করা হয়েছে। চর্যাপদ এবং লেখমালায় মেদ, অন্ধ্র, চন্ডাল, ডোম, শবর ও কাপালি প্রভৃতি বিভিন্ন গোষ্ঠী বা জাতির উল্লেখ আছে। এরা সকলেই অন্ত্যজ পর্যায়ের অন্তর্গত ছিল।

পাল সাম্রাজ্যের  পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলংকার: পালযুগের সামাজিক জীবনে পোশাক-পরিচ্ছদে কোনো বিলাসিতা ছিল না। বিবাহিতা নারীরা শাড়ি পরত। মেয়েরা ওড়না ব্যবহার করত। পুরুষরা সাধারণত পোশাক হিসেবে ধুতি এবং চাদর পরিধান করত। পুরুষরা নাগরা জুতো পরত। সেসময় নারী-পুরুষ উভয়েই অলংকার পরত। নারীরা প্রসাধনী হিসেবে সিঁদুর, কাজল, খোপা বাঁধত, পায়ে রং দিত। নারীরা সোনা ও রুপোর তৈরি অলংকার ব্যবহার করত।

পাল সাম্রাজ্যের বিবাহ: সবর্ণ বিবাহই ছিল সমাজের সাধারণ রীতি। অসবর্ণ বিবাহ একেবারে অপ্রচলিত ছিল না। চর্যাপদে অসবর্ণ বিবাহের উল্লেখ আছে। বিবাহের সময় বরপক্ষকে যৌতুক দেওয়া হত। একটিমাত্র স্ত্রী গ্রহণই ছিল সাধারণ নিয়ম। কিন্তু অভিজাত পরিবারে বহুবিবাহের প্রচলন ছিল। সপত্নী বিদ্বেষ অজ্ঞাত ছিল না। দেবপালের মুঙ্গের লেখতে এবং প্রথম মহীপালের বানগড় লেখতে সপত্নী বিদ্বেষের উল্লেখ আছে।

পাল সাম্রাজ্যের বিনোদন: মাঝে মাঝে নাচ-গানের আসর বসত। নাচ ও গানের তালে তালে যন্ত্রসংগীতও পরিবেশিত হত। রামচরিত, লেখমালা ও চর্যাগীতিতে-এর উল্লেখ আছে। ‘রাজতঙ্গিনী’ কাব্যে পুণ্ড্রবর্ধনের কার্তিকেয় মন্দিরে নিয়মিত নৃত্যসংগীত অনুষ্ঠানের সংবাদ আছে। পাহাড়পুর ও ময়নামতীর পোড়ামাটির ফলকে এবং অসংখ্য ধাঁচে ও প্রস্তরমূর্তিতে নানা ভঙ্গিতে নৃত্যরত পুরুষ ও রমণীর প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ আছে।

পাল সাম্রাজ্যের শিক্ষাদীক্ষা: পালযুগের লেখমালা ও সাহিত্য থেকে জানা যায়, পালপর্বে বাংলা- বিহারে বেদ, বেদান্ত, মীমাংসা, নীতি ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, স্মৃতি, তর্ক, আগম, পুরাণ, কাব্য ইত্যাদি বিবিধ বিদ্যার চর্চা হত। এসব বিদ্যাচর্চা শুধু ব্রাহ্মণ পন্ডিত ও বিদ্বজন সমাজেই আবন্ধ ছিল না, পদস্থ রাজপুরুষেরা এসব শাস্ত্রের অনুশীলন করতেন। চিকিৎসাশাস্ত্রেরও চর্চা হত। নালন্দা, ওদন্তপুরী, সোমপুরী, জগদ্দল, কনকস্তূপ-এ বিক্রমশীলার মতো বিহার ও মহাবিহারগুলি বৌশ্বশিক্ষার প্রসিদ্ধ কেন্দ্র ছিল।

পাল সাম্রাজ্যের  অর্থনৈতিক জীবন। কৃষিই ছিল পালযুগের জনসাধারণের প্রধান জীবিকা এবং রাষ্ট্রকোশের প্রধান উৎস। ধানই ছিল প্রধান কৃষিজ ফসল। উত্তর বাংলায় ভালো জাতের এবং নানা ধরনের ধানচাষের উল্লেখ আছে রামচরিতে। খরা, অতিবৃষ্টি এবং বন্যার ফলে চাষের ক্ষতি হত। চাষিকে ক্ষেত্রকর, কর্ষক এবং কৃষক বলা হয়েছে সমকালীন লেখমালায়। ধান ছাড়াও আম, নারিকেল, বাঁশ প্রভৃতি দ্রব্য পাল আমলে প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হত। সেই সময় বাংলা সুগন্ধি শালিধানের জন্য বিখ্যাত ছিল। দেবপালের মুঙ্গের লিপি থেকে জানা যায় যে, সে সময়ে জমিতে আম এবং পুকুরে মাছ উৎপাদিত হত। বিভিন্ন চিত্র থেকে গোরু, ঘোড়া, শূকর, উট, হরিণ ও বানরের কথা জানা যায়।

পাল সাম্রাজ্যের শিল্প: পালযুগে বস্ত্রশিল্প ছিল বিখ্যাত। বাংলার পালযুগের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন আরবীয় পর্যটক সুলেমান, আল মাসুদি, ইবন সুরদাদব, আল ইদ্রিসি প্রমুখ। বাংলার। মিহি সুতার কাপড়ের আরব ও চিনা পর্যটকরা উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন। চর্যাপদ থেকে জানা যায় যে, বাংলায় ‘দুকুল’ নামে রেশমের কাপড় তৈরি হত। এ ছাড়াও পালযুগে বাংলার অন্যতম প্রাচীন শিল্প ছিল চিনি। সেইসময় বাংলার জাহাজ নির্মাণ ছিল বিখ্যাত। পালযুগে নৌশিল্পের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

পাল সাম্রাজ্যের খনিজ দ্রব্য: পালযুগে বাংলায় প্রচুর পরিমাণে খনিজ দ্রব্য উৎপাদন হত বলে জানা যায়। মেদিনীপুরে লবণ উৎপাদনের কথা জানা যায়। পুণ্ড্রবর্ধনে সোনার খনি ছিল। গঙ্গায় মুক্তা পাওয়া যেত। এ ছাড়া বাংলায় পিতল ও কাঁসার জিনিস বিখ্যাত ছিল।

অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য পাল আমলে বাংলার অভ্যন্তরীণ অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। নদীমাতৃক দেশ হিসেবে নৌবাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল এসময়। কারণ নদীপথের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌকা। নদীপথে আমদানি এবং রপ্তানির সুবিধা থাকায় বাংলায় বিভিন্ন জায়গায় ব্যাবসার কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল।

গৃহপালিত জীবজন্তু পালযুগের অর্থনীতি অনেকাংশে গৃহপালিত জীবজন্তুর ওপর নির্ভরশীল ছিল। গৃহপালিত পশুর মাধ্যমে একদিকে চাষ-আবাদ করা হত, আবার অন্যদিকে দুধ ও মাংসের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল। পাল আমলে বাংলায় গৃহপালিত জীবজন্তুর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গাভী, মহিষ, হস্তী, অশ্ব, ছাগল ইত্যাদি।

পাল সাম্রাজ্যের সম্পদ বণ্টন: পাল সমাজে দরিদ্র শ্রমজীবী, কৃষক, কারিগরি শ্রেণি ছিল। এরা অর্থহীন বলে দরিদ্র শ্রেণি হিসেবে জীবনযাপন করত। অন্যদিকে উচ্চশ্রেণির লোকেরা সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করত। সামন্ততান্ত্রিক সমাজে নিয়ম অনুযায়ী সামন্তরাই সমাজে অর্থ ও সমৃদ্ধি ভোগ করে সম্পদশালী হতে থাকে।পাল সাম্রাজ্যের মুদ্রা ও কড়ি: এ কথা সত্য যে, পালরাজরা কোনো মুদ্রা উৎকীর্ণ করেননি। তবে তার অর্থ এই নয় যে, পালরাজ্যে মুদ্রার প্রচলন ছিল না। সেসময় জিনিসপত্রের লেনদেনের কাজে পুরাতন আমলে মুদ্রা ব্যবহৃত হত। তা ছাড়া ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে সমকালীন প্রচলিত মুদ্রাও এ অঞ্চলের বাজারে প্রচলিত ছিল। পাল সাম্রাজ্যে মুদ্রার প্রচলন থাকলেও ব্যাবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে কড়ির বহুল ব্যবহার ছিল। জিনিসপত্রের ক্রয়-বিক্রয়ে হিসাবের মান ছিল কপর্দক-পুরাণ। পাল তাম্রশাসনে কপর্দক-পুরাণের উল্লেখ আছে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDBengali
Powered by TranslatePress

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading