প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তি তথা গোষ্ঠীজীবনে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রভাব প্রত্যক্ষ করে কার্ল ম্যানহেইম (Karl Mannheim) এবং বটোমোর (T. B. Bottomore) সামাজিক নিয়ন্ত্রণকে দু’ভাগে বিভত্ব করেছেন যথা-প্রত্যক্ষ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এবং পরোক্ষ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ। প্রত্যক্ষ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হলো সমাজের সেইসকল নিয়ন্ত্রণবিধি যেগুলি ব্যক্তির জীবনধারাকে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এটি ব্যক্তিজীবনে সরাসরি কার্যকর হয় এবং ব্যক্তির আচরণকে অধিক হারে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। পরিবার, প্রতিবেশী, বন্ধুগোষ্ঠী, খেলার দল এবং অন্যান্য প্রাথমিক গোষ্ঠী সদস্যদের আচরণকে সরাসরি প্রভাবিত করে। তবে আধুনিক জটিল সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করে এরূপ বলা যায়, এখানে ব্যক্তির সামগ্রিক জীবন সর্বদা কোনো একটি ব্যবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। বিভিন্ন গোষ্ঠী, কার্যালয়, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা আংশিকভাবে এবং পৃথক পৃথক অবস্থায় আমাদের আচরণকে কখনো প্রত্যক্ষভাবে আবার কখনো পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যেমন-পুলিশ, প্রশাসন, আইন, আদালত প্রভৃতি বিধিবন্ধ বা প্রত্যক্ষভাবে আমাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। ব্যক্তি তার জীবনে এই ধরনের বিধিব্যবস্থার গন্ডির বাইরেও কার্য সম্পাদনে উদ্যোগী হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আইন আদালত ইত্যাদির ভয়ে পরোক্ষভাবেও ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রণ হতে পারে।
পরোক্ষ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তির মধ্যে সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণার উদ্ভব ঘটানো, যাতে ব্যক্তি বিচ্যুতির পথে। যেতে না পারে। পরোক্ষভাবে লোকাচার, লোকনীতি, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, শিক্ষা, ধর্ম প্রভৃতির সহায়তায় এই নিয়ন্ত্রণ কার্যকর হয় বলে একে পরোক্ষ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বলা হয়। আমাদের অজ্ঞাতসারে এটি পরিচালিত হওয়ায় প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের মতো এটি সক্রিয়ও সুদৃঢ় হয় না। ইতিবাচক এবং নেতিবাচক সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে
সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রকারভেদ আলোচনা করতে গিয়ে বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক কিম্বল ইয়ং দু’টি সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কথা উল্লেখ করেছেন, ইতিবাচক এবং নেতিবাচক সামাজিক নিয়ন্ত্রণ। সামাজিক নিয়ন্ত্রণ যখন স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্বাভাবিকভাবে ব্যক্তিকে শৃঙ্খলাবন্ধ হতে আগ্রহী করে তোলে, তখন এই প্রকার শৃঙ্খলাপরায়ণতাকে ইতিবাচক সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বলা হয়। সম্মানসূচক উপাধি প্রদান, আর্থিক পুরস্কার প্রদান, প্রশংসা প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে যখন সমাজস্বীকৃত পন্থা-পদ্ধতির অনুকূলে উৎসাহিত করতে নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া সংগঠিত হয়, তখন তা ইতিবাচক সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে পড়ে। এই ক্ষেত্রে ব্যক্তি এমন কোনো কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে না যা সমাজের সকলের চোখে নিন্দনীয় বলে মনে হয়। এই ধরনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ গঠনের ক্ষেত্রে সামাজিকীকরণের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়। সামাজিকীকরণের দ্বারা শৈশব থেকে আমাদের মধ্যে কিছু আচার-আচরণ ইত্যাদি এই ধরনের নিয়ন্ত্রণবিধির মাধ্যম বিশেষ। অপরদিকে, যেসকল আচরণবিধি গঠনের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো সচেতনতা অবলম্বনের প্রয়োজন হয় না মোটামুটি সহজাত বা সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রণবিধি ব্যক্তিমনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবস্থান করে, সেই ধরনের নিয়ন্ত্রণবিধিকে অচেতন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি হিসাবে মানা হয়। যেমন-লোকাচার, লোকনীতি, মূল্যবোধ প্রভৃতি। এই নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সহজসরল সমাজে অধিকতর কার্যকরী বলে মনে করা হয়।