প্রথম আফিম যুদ্ধের উৎপত্তি (1839-1842):
প্রথম আফিম যুদ্ধ (1839-1842) চীনের চিং সাম্রাজ্য ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে সংঘটিত হয় এবং এর মূল কারণ ছিল আফিম বাণিজ্য। ১৮০০ শতকের শুরুতে, ব্রিটেন ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়, তবে এটি একপেশে ছিল। চীন ব্রিটেন থেকে কিছুমাত্র পণ্য আমদানি করলেও ব্রিটেন চীনা পণ্য বিশেষ করে চা, সিরামিক এবং রেশমের জন্য ব্যাপক পরিমাণে সিলভার (রূপা) প্রদান করতে বাধ্য হতো। এর ফলে ব্রিটেনের বড় আর্থিক ক্ষতি হচ্ছিল, কারণ চীনে ব্রিটিশ পণ্যদের খুব একটা চাহিদা ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ বাণিজ্যীরা একটি উপায় বের করে, যা ছিল আফিমের বাণিজ্য। আফিম, যে মাদক চীনেও জনপ্রিয় ছিল, ব্রিটিশরা এটি চীনে রপ্তানি করতে শুরু করে। আফিম চীনে আসার পর এটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং চীনা জনগণের মধ্যে তা ব্যবহার বাড়তে থাকে। এর ফলে চীনের সমাজ ও অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। ১৮৩৯ সালে চীনের গোবির্নর লিন জিচাও (Lin Zexu) আফিমের ক্ষতিকর প্রভাব ও এর জন্য বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
আফিমের বিরুদ্ধে চীনের পদক্ষেপ:
লিন জিচাও চীনের সম্রাটের আদেশে ১৮৩৯ সালে গুয়ানঝু (Guangzhou) শহরের বন্দর এলাকায় থাকা ব্রিটিশ বাণিজ্যিক অফিস ও দোকানে অভিযান চালান। সেখানে তিনি প্রায় ২০,০০০ বস্তা আফিম ধ্বংস করেন এবং এটি চীনের সরকারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হয়। একই সময়ে, ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা এই আফিম বাণিজ্য থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করছিল এবং চীনে তাদের স্বার্থ হুমকির মধ্যে পড়েছিল।
লিনের পদক্ষেপের পর, ব্রিটেন প্রতিশোধ নিতে চায় এবং একটি সামরিক আক্রমণ শুরু করে। ব্রিটিশ সরকার এই আফিম ধ্বংসের ঘটনাকে তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থের বিরুদ্ধে আক্রমণ হিসেবে মনে করে। তারা চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং আফিমের নিষেধাজ্ঞাকে অগ্রাহ্য করে।
যুদ্ধের সূচনা ও সংঘর্ষ:
১৮৪০ সালে, ব্রিটেন চীনের ওপর আক্রমণ শুরু করে, যেখানে তারা আধুনিক ইউরোপীয় সামরিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ব্রিটিশরা চীনের সমুদ্র বন্দরগুলোতে আক্রমণ করে এবং শহরগুলোর ওপর অবরোধ চালায়। চীনের সেনাবাহিনী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করলেও তারা পশ্চিমী শক্তির আধুনিক যুদ্ধ প্রযুক্তির সামনে খুবই দুর্বল ছিল। ব্রিটিশ বাহিনী সশস্ত্র যুদ্ধ এবং অবরোধের মাধ্যমে চীনের সমুদ্র ও নদী পথগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে, এবং চীনা শহরগুলোর উপর আক্রমণ অব্যাহত রাখে।
এছাড়া, ব্রিটেন চীনের পূর্ব উপকূলে আক্রমণ চালিয়ে দ্রুত তাদের আধিপত্য বিস্তার করে। তারা চীনের ক্যানটন, নিংপো, শাংহাই, এবং ফুচৌ শহরগুলোতে আক্রমণ করে এবং শহরগুলো দখল করে।
শান্তি চুক্তির শর্তাবলী:
যুদ্ধের ফলস্বরূপ, চীনের চিং সাম্রাজ্য পরাজিত হয় এবং ১৮৪২ সালে নানকিং চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা প্রথম আফিম যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটায়। এই চুক্তির প্রধান শর্তগুলো ছিল:
- হংকং ব্রিটেনের কাছে হস্তান্তর: ব্রিটিশদের কাছে হংকং দ্বীপটি চিরকাল জন্য হস্তান্তর করা হয়।
- পাঁচটি বন্দর খুলে দেওয়া: চীনের পাঁচটি শহর (ক্যান্টন, শাংহাই, নিংপো, আময়, ফুচৌ) ব্রিটিশ বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
- ক্ষতিপূরণ প্রদান: চীন ব্রিটেনকে ২১ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ প্রদান করে, যা আফিম বাণিজ্যের ক্ষতির জন্য দেওয়া হয়।
- চীনে ব্রিটিশ কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্ব: ব্রিটেন চীনে কূটনৈতিক প্রতিনিধি রাখার অধিকার পায় এবং ব্রিটিশ নাগরিকদের বিশেষ আইনি সুবিধা দেওয়া হয়।
ফলস্বরূপ পরিণতি:
প্রথম আফিম যুদ্ধের পর, চীনের সার্বভৌমত্ব অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এটি চীনের উপর বিদেশি শক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ প্রশস্ত করে। চীনে বিদেশি বাণিজ্য এবং রাজনৈতিক উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়, যার ফলে চীন “অপমানের শতাব্দী” (Century of Humiliation) হিসেবে পরিচিত হয়। এর ফলে চীনে ব্যাপক সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে এবং এই পরিস্থিতি পরবর্তীতে আরো সংঘর্ষ এবং বিপ্লবের দিকে পরিচালিত হয়, যার মধ্যে তিয়েনচিন বিদ্রোহ এবং বক্সার বিদ্রোহ উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া, এই যুদ্ধের পর ব্রিটেন চীনকে আফিম বাণিজ্য অব্যাহত রাখতে বাধ্য করে, যা চীনা জনগণের জন্য আরো সংকট সৃষ্টি করে। আফিমের ব্যবহার চীনে ব্যাপক হারে বাড়ে, এবং এই মাদক চীনা সমাজের জন্য এক সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক বিপর্যয়ের সূচনা করে।
উপসংহার:
প্রথম আফিম যুদ্ধ চীনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল, যা বিদেশি শক্তির আধিপত্য ও চীনের সার্বভৌমত্বের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এটি চীনে আধুনিকতাবাদের প্রতি এক ধরনের অপ্রত্যাশিত উদ্বুদ্ধতা তৈরি করলেও, এর ফলে চীনের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি এবং সমাজের উপর এক দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়ে।