প্রাচীন উত্তরবঙ্গের সংগীত ও নৃত্য সংস্কৃতি :
নৃত্যগীতবাদ্যের প্রচলন ও প্রসার সম্বন্ধে প্রমাণ সুপ্রচুর। রামচরিত, পবনদপ্ত প্রভৃতি কাব্যে, নানা লিপিতে, সদুক্তিকর্ণামৃতের শ্লোকে, চর্যাগীতি ও দোহাকোশের নানা জায়গায় নানা সূত্রে নৃত্যগীত বাদ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। উচ্চ ও নিম্নকোটি উভয় শ্রেণির মানুষদের মধ্যে এই দুই বিদ্যা সম্বন্ধে সমাদর ছিল যথেষ্ট। বারাসনা ও দেবদাসীরা যে নানা কলানিপুণ ছিলেন, এ কথার ইঙ্গিত সেন লিপিতে এবং পবনদূতেও আছে। ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থে দেখা যায়, পুণ্ড্রবর্ধনের কার্তিকের মন্দিরে যে নৃত্যগীত হত তা ভারতের নাট্যশাস্ত্রানুযায়ী এবং নৃত্যগীতমুগ্ধ জয়ন্ত স্বয়ং ভরতানুমোদিত নৃত্যগীত শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। পোড়ামাটির ফলকগুলিতে অসংখ্য ধাতব ও প্রস্তরমূর্তিতে নানা ভঙ্গিতে নৃত্যরত পুরুষ ও নারীর প্রতিকৃতি সুপ্রচুর। বুদ্ধধর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেই নটি পৃথক বর্ণ হিসেবেই উল্লিখিত হয়েছে সমাজের নিম্নতম স্তরে। কিন্তু উচ্চকোটিরও কেউ কেউ নট-নটির বৃত্তি গ্রহণ করতেন। জয়দেব গৃহিণী পদ্মাবতী প্রাক্-বিবাহ জীবনে কুশলী নটি ছিলেন এবং সংগীতে খুব পারদর্শী ছিলেন। বিভিন্ন প্রকার বাদ্যযন্ত্রের কথা আমরা জানতে পারি, যেমন-কাঁসর, করতাল, ঢাক, বীণা, বাঁশি, মৃদঙ্গ প্রভৃতি। রামচরিতে দেখা যায়, বরেন্দ্রীতে (বর্তমান মালদা) বিশেষ এক ধরনের মুরজ (মৃদঙ্গ) বাদ্য প্রচলিত ছিল, বাংলার অন্যত্র বোধ হয় অন্য প্রকারের মুরজের প্রচলন ছিল। সদুক্তিকর্ণামৃতের একটি শ্লোকে এই রজ্জবীণার উল্লেখ পাওয়া গেছে। বুদ্ধ-নাটকের উল্লেখ লক্ষ করা যায়। নৃত্য এবং গীতের সাহায্যে এক ধরনের নাট্যাভিনয় বোধ হয় প্রাচীন উত্তরবাংলায় সুপ্রচলিত ছিল এবং এই নাচ-গানের মধ্যে দিয়েই বোধ হয় কোনো বিশেষ ঘটনাকে রূপদান করা হত। লোকায়ত, সমাজে এবং সামাজিক ও ধর্মগত উৎসব-অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে নানা ক্রিয়াকর্মে নৃত্যগীতের প্রমাণ সমসাময়িক শিল্প সাহিত্যে সুস্পষ্ট। চর্যাগীতির একটি গীতে সমসাময়িক বিবাহযাত্রার বর্ণনা পাওয়া যায় এবং এই প্রসঙ্গে কয়েকটি বাদ্যযন্ত্ররও উল্লেখ পাওয়া যায়।